Ticker

6/recent/ticker-posts

মেকলে মিনিটস বা মেকলে প্রতিবেদন



পটভূমি:-

টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ছিলেন ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের অন্যতম পথিকৃৎ। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সনদ আইনে ৪৩ নং ধারায় ভারতের শিক্ষা খাতে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করার কথা ঘোষণা করা হয়। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে গঠিত শিক্ষাসভা কে .(C.P.I-General Committee of Public Instruction)  ভারতীয় শিক্ষার উন্নয়নের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। 

  কিন্তু শিক্ষা সভার সদস্যরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। এই এক লক্ষ টাকা প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষাখাতে ব্যয় হবে তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। 

   অবশেষে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের আইনসচিব মেকলে কে "পাবলিক ইন্সট্রাকশন কমিটির” সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত করেন। মেকলে বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি  ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের জন্য সরকারের কাছে কতকগুলি সুপারিশ পেশ করেন। এই সুপারিশই "মেকলে প্রতিবেদন” বা "মেকলে মিনিটস” নামে খ্যাত।


প্রাচ্যবাদী বনান পাশ্চাত্য বাদী:-

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সনদ আইন এর ৪৩ নং ধারায় শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা ব্যয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে গঠিত শিক্ষা সভাকে (G.C.P.I-general committee of public instruction) ভারতীয় শিক্ষার উন্নয়নের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এই এক লক্ষ টাকা প্রাচ্য না পাশ্চাত্য শিক্ষা খাতে ব্যয় হবে তা নিয়ে শিক্ষা সভার সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। তাঁরা দুটি দলে বিভক্ত হয়। যথা:-


১) প্রাচ্যবাদী(ওরিয়েন্টালিস্ট):- যাঁরা প্রাচ্য  শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয়ের কথা বলেন তারা হলেন প্রাচ্যবাদী। তাঁদের মতে শিক্ষাখাতের জন্য বরাদ্দএক লক্ষ টাকা ভারতীয় সাহিত্য, দর্শন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি খাতে ব্যয় করা হোক। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-এইচ.টি. প্রিন্সেপ, উইলসন, কোল ব্রুক প্রমূখ।


২) পাশ্চাত্য বাদী (অ্যাংলিসিস্ট):-যাঁরা পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য অর্থ ব্যয়ের কথা বলেন, তাঁরা হলেন পাশ্চাত্য বাদী এরা আবার দুই দলে বিভক্ত। দুই দলই পাশ্চাত্য শিক্ষা চাইতেই কিন্তু ক) একদল চাইতেন যে, শিক্ষার মাধ্যম ও হোক ইংরেজি ভাষা।


৩) অন্যদল বলতেন যে, ইংরেজি ভাষা শিক্ষণীয়, তবে পাশ্চাত্য শিক্ষা মাধ্যম হোক মাতৃভাষা। নইলে, নতুন শিক্ষা সর্বজনীন হতে পারবে না। তাঁরা চাইতেন শিক্ষার বিষয়বস্তু হবে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতি।


পাশ্চাত্যবাদীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- রেভারেন্ড আলেকজান্ডার ডাফ, হাইড ঈস্ট, রামমোহন রায়, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাধাকান্ত দেব, রসময় দত্ত, বেথুন সাহেব, উইলিয়াম জোন্স, ডেভিড হেয়ার প্রমূখ।


দেশীয় ভাষা সম্পর্কে মেকলের মন্তব্য:-

মেকলে শিক্ষিত হলেও ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। এদেশের শিক্ষা সংস্কৃতির প্রতি তাঁর একটা তুচ্ছ- তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল। তিনি তাই বলেন যে, দেশীয় ভাষা গুলি অত্যন্ত দীন ও অমার্জিত। তাঁর মতে প্রাচীন প্রাচ্য ভাষা, যথা:- সংস্কৃত ও আরবি, ইংরেজি ভাষা অপেক্ষা নিকৃষ্টতর।

   তিনি মনে করেন, "ইউরোপীয় যেকোনো একটা ভালো গ্রন্থাগারের একটি তাকে যে সাহিত্য সম্পদ আছে, তা ভারত ও আরব দেশের সাহিত্য ভান্ডারের  সমান(A single shelf of good European library is worth the whole native literature of India and Arabia)।”  কাজেই তাঁর রায় হল, ইংরেজি হবে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা।

   মেকলে চেয়েছিলেন এমন একটি শিক্ষিত সম্প্রদায় গড়ে তুলতে, যা রক্ত ও বর্ণের দিক থেকে ভারতীয় হলেও রুচি মতাদর্শ নীতি ও বুদ্ধির দিক থেকে খাঁটি ইংরেজ হবে।

   সুতরাং ইংল্যান্ডের দায়িত্ব হলো যা ভারতীয়দের পক্ষে ভালো তা-ই শেখানো, যা কেবল রুচিকর তা নয়।


 মেকলে মিনিটস এর প্রস্তাব:-

১) শিক্ষার উদ্দেশ্য:-মেকলে কেবলমাত্র অভিজাত ও মধ্যবিত্তদের ইংরেজি শিক্ষা শিক্ষিত হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে রায় দিয়ে বলেন যে, ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা দান করার নীতি সরকারের গ্রহণ করা উচিত। মেকলে এই যুক্তি দেন যে,মাতৃভাষার মাধ্যমে স্কুল চালাতে গেলে সরকারের খরচ অনেক বেড়ে যাবে।

    সুতরাং এদেশে কিছু লোক যদি ইংরেজি মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা আয়ত্ত করতে পারে তাহলে আশা করা যায় যে, তাদের সংযোগে জনসাধারণের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা ছড়িয়ে পড়বে। এই যুক্তিকে বলা হত "ইনফিল্ট্রেশন থেওরি”। 

   অর্থাৎ মুষ্টিমেয় কয়েকজন পাশ্চাত্য শিক্ষিত ব্যক্তির মধ্য দিয়ে পরিশ্রুত হয়ে ইংরেজি শিক্ষা জনগণের মধ্যে স্রোতস্বিনী রাখার নেবে।

২) শিক্ষার বিষয়বস্তু:- ভারতীয় শিক্ষার বিষয়বস্তু হবে পাশ্চাত্য জ্ঞান- বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি।

৩) শিক্ষার মাধ্যম:- শিক্ষার মাধ্যম হবে ইংরেজি। দেশীয় ভাষা দীন ও অমার্জিত এবং দেশীয় লোকেরা ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহী, তাই ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

৪)  সরকারি নীতি:- সরকারি অকেজো প্রাচ্য শিক্ষাদানের কেন্দ্রগুলি বন্ধ করে দেয়া হবে। এর থেকে যে অর্থের সাশ্রয় হবে  পাশ্চাত্য শিক্ষার উন্নতি কল্পে সরকার তা খরচ করবে।


ফলাফল:-

১) ১৮৩৫ সালের ৭ ই মার্চ বেন্টিঙ্ক মেকলের প্রতিবেদন মেনে নেয়। সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয় যে, এখন থেকে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ সরকারি অর্থ ইংরেজি শিক্ষার জন্যই ব্যয় করা হবে।

বেসরকারি চেষ্টায় ইংরেজি শিক্ষা এমনিতেই এগিয়ে ছিল, এবার বেন্টিঙ্কের সরকারি ঘোষণার ফলে তা আরও দ্রুতগামী হল। 

২) আইন-আদালতে ফারসি ভাষার জায়গা দখল করল ইংরেজি ভাষা।

৩) সনাতন দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থা অর্থাৎ পাঠশালা মকতব-টোল- মাদ্রাসা- শ্রীহীন হয়ে পড়ে।


   ১৮৩৫ সালে বেন্টিঙ্কের কাছে অ্যাডাম(Adam) সাহেব শিক্ষা বিষয়ক রিপোর্ট পেশ করেন, তা থেকে জানা যায় যে, ইংরেজি শেখার ব্যবস্থা না থাকলে কোন বিদ্যালয়ই চলত না।

৪) ১৮৩৫ সালে বেন্টিঙ্ক এর আমলে কলকাতায় খোলা হয় মেডিকেল কলেজ(Medical College) এবং বোম্বাইয়ের এলফিনস্টোন ইনস্টিটিউশন(Elphinstone Institution),

৫) ক্যাথলিক জেসুইট ধর্মপ্রচারক সম্প্রদায় গঠন করলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ(St.Xavier’s college), কলকাতার পাবলিক লাইব্রেরীর(Calcutta  public library) জন্মও ১৮৩৫ সালে। পরে এর নাম হয় ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরি(imperial library). এখন এটি জাতীয় গ্রন্থাগার।

৬) দাতা হাজী মুহাম্মদ মহসিনের অর্থানুকূল্যে তাঁর মৃত্যুর পর ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হুগলি মহসীন কলেজ।


মন্তব্য:-

মেকলে মিনিটস ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসঙ্গে নব দিগন্ত উন্মোচন করে। সমাজের উচ্চবর্গের ভারতীয়দের মধ্যে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তার লাভ ঘটে। নিম্নবর্গের মানুষের কাছে না পৌঁছলেও নিচু তলায় আধুনিক চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটে।

Post a Comment

0 Comments