সূচনা:-
প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান হিসেবে লিপির গুরুত্ব অপরিসীম। অধ্যাপক র্যাপসন এর মতে,-" প্রাচীন লিপি একটি দেশ ও যুগের সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করে।
সাধারণভাবে পাথর, লোহা, রুপা ও সোনার ওপরে এবং মন্দিরগাত্রে, এমনকি বিভিন্ন মূর্তির গায়েও লিপি খোদাই করা হত। মাটির উপরিভাগে বিশেষ করে পর্বত গাত্রেই যে শিলালেখ পাওয়া যায় তাই নয়, মাটির তলা থেকেও শিলালেখ পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রায় সমস্ত শিলালেখ বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
লিপির গুরুত্ব:-
১) রাজনৈতিক ঘটনা জানায়:-
লিপি থেকে বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক ঘটনা, রাজাদের যুদ্ধ- বিগ্রহ, রাজ্যসীমা, রাজার নাম, পরিচয়, তাঁর শাসনকাল সহ বিভিন্ন কীর্তি কাহিনী জানা যায়।
উদাহরণ:-
I) সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণ রচিত "এলাহাবাদ প্রশস্তি” থেকে গুপ্ত যুগের ও তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক চিত্রও প্রতিভাত হয়। মধ্যভারত ও রাজস্থানের বিস্তীর্ণ এলাকায় যে তখন প্রজাতান্ত্রিক উপজাতির শাসন বলবৎ ছিল এবং গুপ্ত সাম্রাজ্যবাদের আঘাতে তা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল তা এই প্রশস্তি থেকে বোঝা সম্ভবপর হয়।
ii) আনুমানিক ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে চালুক্য রাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর সভাকবি রবিকীর্তির আইহোল প্রশস্তিতে, দ্বিতীয় পুলকেশী কর্তৃক উত্তর ভারতের সমকালীন প্রভাবশালী শাসক হর্ষবর্ধনের পরাজয়ের কথা সযত্নে তুলে ধরেছেন।
iii) গোয়ালিয়র প্রশস্তি তে "মিহির ভোজের’ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা চিত্রিত হয়েছে।
iv) দেওপাড়া প্রশস্তি তে বিজয় সেনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা জানা যায়।
v) পাল শাসক ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসনে, পাল বংশ শুরুর প্রাক্কালে বাংলায় অরাজকতা তথা মাৎস্যন্যায়ের উল্লেখ আছে।
২) শাসন নীতির পরিচয় মেলে:-
লিপিতে উৎকীর্ণ তথ্য থেকে রাজার শাসন নীতি, শাসন সংস্কার এবং বিভিন্ন প্রজা কল্যাণমূলক কাজের বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন:-
i) ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে "এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল” এর সম্পাদক "জেমস প্রিন্সেপ” কর্তৃক অশোকের লিপির পাঠোদ্ধারের পর জানা যায়, " অশোকের ধর্মমত ও জনহিতকর কার্যকলাপের বিবরণ।”
৩) বৈদেশিক সম্পর্ক বোঝায়:-
বিদেশে প্রাপ্ত লিপি গুলি থেকে ভারতের সঙ্গে দেশগুলির রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, পরিচয়ের কথা জানা যায়।
উদাহরণ:-
i) এশিয়া মাইনরে হিটাইট রাজাদের লেখ থেকে আর্য রাজাদের পরিচয় ও বিভিন্ন সন্ধির উল্লেখ পাওয়া যায়।
ii) "বোঘাজ কয়” নামক স্থানে মে লেখ পাওয়া যায় তাতে বৈদিক আর্যদের বিভিন্ন দেবতার উল্লেখ আছে। এছাড়া ভারতবর্ষে আর্যদের অনুপ্রবেশের আগে তাদের কিছু প্রচেষ্টার ও আভাস মেলে এই লেখটি থেকে।
iii) ইরানে দারায়ুসের "পারসিপোলিস” ও "নাকস-ই- রুস্তম” লেখ এ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে প্রাচীন ইরানের সঙ্গে ভারতবর্ষের ঘনিষ্ঠ সংযোগের ইঙ্গিত দেয়।
iv) বেহিস্তান লেখ থেকে জানা যায়, উত্তর পাঞ্জাব ও গন্ধার পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
v) চম্পা,যবদ্বীপ, কম্বোডিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে প্রাপ্ত লেখ থেকে জানা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের কথা।
৪) অর্থনীতির ধারণা দেয়:-
লিপি সমকালীন বিভিন্ন রাজ্যের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা ও অর্থনীতির সম্যক ধারণা দেয়।
যেমন:-
i) সাতবাহন ও গুপ্ত যুগের তাম্রফলকে জমি বিক্রি বা জমি দান সংক্রান্ত বিষয় গুলি লিপিবদ্ধ থাকত। এছাড়া ভূমি দানের উদ্দেশ্য, ভূমি রাজস্ব, এবং ভূমি সংক্রান্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে থাকে। রাজস্ব এবং ভূমি সংক্রান্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে থাকে তাম্রফলকগুলি। জমি বিক্রয় ও জমি দানের মাধ্যমে তাম্রশাসনগুলি জমি হস্তান্তরের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
ii) গুপ্ত আমলে বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত বিশেষত "পুন্ড্রবর্ধনভুক্তি” বা উত্তরবঙ্গ এলাকায় প্রাপ্ত তাম্রশাসন গুলি থেকে বিভিন্ন ধরনের জমি বা জমি মাপার পদ্ধতির কথা জানা যায়।
৫) ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় দেয়:-
দেব মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ লিপি গুলি সমকালীন ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় দেয়।
যেমন:-
I) অশোকের ধর্ম লিপিগুলি থেকে বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।
ii) মালদহ জেলার জগজ্জীবনপুর মৌজায় ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে জগদীশচন্দ্র গাইনের কোদালের ডগায় আবিষ্কৃত তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, পাল শাসকেরা বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কেননা, বৌদ্ধদের উদ্দেশ্যে মহেন্দ্রপালদেব মে জমি দান করেছিলেন তা লিপিবদ্ধ হয়েছে এই তাম্রশাসনটিতে।
৬) ভাষা চর্চার ধারণা দেয়:-
লিপি গুলিতে ব্যবহৃত করা ভাষা থেকে সেকালে প্রচলিত ভাষা ও তার বিবর্তন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
উদাহরণ:-
i) খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত মৌর্য সম্রাট অশোকের লেখমালার ভাষা ছিল প্রাকৃত।
ii) খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে যে লিপি গুলি খোদাই করা হয়েছিল তার ভাষা ছিল সংস্কৃত।
iii) গুপ্তযুগে অর্থাৎ খ্রিস্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায় ও প্রাকৃত ভাষার প্রচলন হ্রাস পায়।
iv) খ্রিস্টীয় নবম ও দশম শতাব্দীতে শিলালিপি রচনার কাজে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা,তথা:- সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়।
v) প্রাক্ মধ্যযুগের লেখমালায় প্রথম আরবি ভাষার প্রচলন ঘটে।
vi) হরপ্পা সভ্যতার লেখামালাগুলির পাঠোদ্ধার সম্ভব না হওয়ায় তার ভাষা ও লিপি সম্পর্কে আমরা অজ্ঞাত।
vii) অল্প কিছু লেখ পাওয়া যায় যেগুলি বিদেশীয়,বিশেষ করে গ্রিক বা আরামীয় ভাষায় রচিত।
৭) লিপির ধারণা দেয়:-
লেখগুলির লিপি বা বর্ণমালা থেকে লিপির বিবর্তন সম্পর্কে জানা যায়।
যেমন:-
I) প্রাচীন ভারতীয় ভাষায় রচিত লেখাগুলি ব্রাহ্মী, খরোষ্ঠী,ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী, অক্ষর যুক্ত বিমিশ্রিত লিপি, তথাকথিত শঙ্খ লিপি এবং ব্রাহ্মী থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন আঞ্চলিক লিপিতে লেখা।
ii) অশোকের লিপি গুলি উত্তর-পশ্চিম ভারতের কয়েকটি এলাকা ছাড়া প্রধানত ব্রাহ্মী লিপিতেই লেখা।
আবার স্থানীয় আদিবাসীদের সুবিধার জন্য সেখানে খরোষ্ঠী লিপি ব্যবহৃত হয়েছিল। আফগানিস্তানে অশোকের সময় উৎকীর্ন শিলালিপি গুলি গ্রিক ও আরামাইক বর্ণমালায় রচিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ব্রাহ্মীই ছিল প্রধান ব্যবহৃত লিপি।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ব্রাহ্মী লিপি লেখা হতো বাঁ দিক থেকে ডান দিকে আর খরোষ্ঠী লিপি ডান দিক থেকে বাঁদিকে। শঙ্খ লিপি অনেক সময় ডান থেকে বাম দিকে লেখা হত।প্রায় সমগ্র এশিয়াতেই এই ভাষার প্রচলন ছিল।
৮) বাণিজ্যিক পরিস্থিতি জানান:-
লিপিগুলি থেকে রাজাদের অন্তবাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের পরিচয় মেলে এবং বাণিজ্যিক সূত্রে কোনো অঞ্চলের ওপর অন্যান্য অঞ্চলের রাজার আধিপত্যের ধারণা পাওয়া যায়।
যেমন:-
i) ইরানে দারায়ুসের "পারসিপোলিস” ও "নাকস-ই-রুস্তম” লেখ এ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে প্রাচীন ইরানের সঙ্গে ভারতবর্ষের ঘনিষ্ঠ সংযোগের ইঙ্গিত দেয়।
ii) চম্পা, যবদ্বীপ, কম্বোডিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে প্রাপ্ত লেখ থেকে জানা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক যোগাযোগের কথা।
iii) "বেহিস্তান” লিপি থেকে জানা যায়, গন্ধার পারস্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
৯) ধারাবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে:-
অন্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের সঙ্গে ধারাবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে শিলালিপি সাহায্য করে।
উদাহরণ:-
I) ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে রিস্থালে প্রাপ্ত লেখ (৫১২ খ্রিস্টাব্দ) থেকে অনুমান করা সম্ভব হয়েছে যে,মালবরাজ যশোধর্মণের আগের শাসক ছিলেন প্রকাশধর্মন। শুধু তাই নয়, প্রকাশধর্মণের পূর্বপুরুষদের একটা তালিকাও এতে আছে।
ii) মালদহ জেলার জগজ্জীবনপুর মৌজায় ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে জগদীশচন্দ্র গাইনের কোদালের ডগায় আবিষ্কৃত তাম্রশাসন থেকে আমাদের দুটি ভুল ধারণা ভেঙে যায়।
যথা:-
ক) এতদিন পর্যন্ত আমরা জানতাম বাংলার পাল শাসক দেবপালের পর প্রথম বিগ্রহপাল সিংহাসনে বসেছিলেন। কিন্তু এই তাম্রশাসন থেকে জানা সম্ভবপর হয়েছে যে, দেবপালের পরে সিংহাসনে বসে ছিলেন তাঁর পুত্র মহেন্দ্রপালদেব।
খ) পাল শাসকরা যে বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তা এই তাম্রশাসনটি থেকে জানা যায়। কেননা, বৌদ্ধদের উদ্দেশ্যে মহেন্দ্রপালদেব যে জমি দান করেছিলেন তা লিপিবদ্ধ হয়েছে এই তাম্রশাসনটিতে।
১০) সাহিত্যের পরিচয় দেয়:-
এমন কিছু লেখ আছে যেগুলি উচ্চ শ্রেণীর সাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে।
উদাহরণ:-
I) হরিষেণ রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি ও রবিকীর্তীর আইহোল প্রশস্তি।
ii) তামিলনাড়ুর কুডুমিয়ামালাইয়ে সঙ্গীতের স্বরলিপি।
iii) রাজস্থানের উদয়পুরে নানা স্বর্গে বিভক্ত রাজ প্রশস্তি কাব্য এবং
iv) আজমীরে "ললিত বিগ্রহরাজ” ও "হরিকেল” নাটক উৎকীর্ণ অবস্থায় পাওয়া গেছে।
সীমাবদ্ধতা:-
লিপির গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় যে, লিপির কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
১) পাঠোদ্ধার সমস্যা:- দুর্বোধ্য অক্ষরে খোদাই করা লিপিতে অনেক সময় সন, তারিখের স্পষ্ট উল্লেখ না থাকায় ঘটনার প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা যায় না। ফলে সেগুলির পাঠোদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়।
২) অতিশয়োক্তি জনিত সমস্যা:- অধিকাংশ লিপি সমকালীন শাসকদের নির্দেশ মেনে বা শাসকের প্রশংসা করে খোদিত হওয়ায় সেগুলি থেকে সঠিক তথ্য জানা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়, কারণ এগুলিতে অতিশয়োক্তি বা কাল্পনিক গুন আরপের সম্ভাবনা থাকে।
৩) নিম্ন শ্রেণীর মানুষেরা তথ্য বহির্ভূত:- সমাজে অপেক্ষাকৃত কম মর্যাদাবান গোষ্ঠীর মানুষদের সম্পর্কে লিপি নিরব থাকায় এদের সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না।
৪) প্রাকৃতিক বিপর্যয় জনিত সমস্যা:- কয়েক শতাব্দী পূর্বে উৎকীর্ন হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে রৌদ্র, ঝড়, জলে অবলুপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
৫) বর্ণনার অমিল:- অনেক সময় লিপি গুলির বর্ণনায় অসম্পূর্ণতা, অসামঞ্জস্য ও বিভ্রান্তি ধরা পড়ে; ফলে লিপিতে উৎকীর্ন বিষয়বস্তুর প্রকৃত অর্থ বোঝা যায় না।
মন্তব্য:-
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান গুলির মধ্যে লিপির শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে বলা যেতে পারে, লিপি হল ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। ডক্টর ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথের মতে- "প্রশ্নাতীতভাবেই লিপি হল ভারত ইতিহাসের সর্বাধিক পর্যাপ্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ উৎস"।
0 Comments