Ticker

6/recent/ticker-posts

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব

সূচনা:-

   প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান রূপে মুদ্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তীর মতে "রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস ছাড়াও প্রাচীন আমলের ধর্মীয় তথা সাংস্কৃতিক ইতিহাস বোঝার জন্য মুদ্রার সাক্ষ্য বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠে"।



মুদ্রার গুরুত্ব:-

১) অর্থনৈতিক অবস্থার ইঙ্গিত দেয়:-

   কোনো মুদ্রা থেকে সংশ্লিষ্ট যুগের অর্থনৈতিক মান নির্ণয় করা সম্ভব।

   ক) উন্নত মানের স্বর্ণমুদ্রা যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষণ। তেমনি নিম্নমানের তাম্র বা সীসার মুদ্রা অর্থনৈতিক সংকটের নির্দেশক।

   খ) মুদ্রায় খাদের পরিমাণ হ্রাস বৃদ্ধির ওপরেও সংশ্লিষ্ট যুগের উন্নতি-অবনতি নির্ভর করে।

   উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, স্কন্দগুপ্তের সময় পর্যন্ত যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বজায় ছিল, তা বোঝা যায় সেই যুগের উন্নত মানের মুদ্রাগুলি ও সমস্ত শ্রেণীর মুদ্রায় খাদের পরিমাণের স্বল্পতা দেখে।

   ঠিক এর বিপরীত ভাবে, পঞ্চম শতাব্দীর শেষ ও ষষ্ঠ শতাব্দীর গোড়ায়, মুদ্রায় খাদের পরিমাণ বৃদ্ধি প্রমাণ করে যে, সে যুগে অর্থনৈতিক সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।


২) কাল পরস্পরা নির্ণয়ে সাহায্য করে:-

   মুদ্রায় খোদিত সন তারিখ থেকে রাজার শাসনকাল সম্পর্কে জানা যায়। এছাড়া বিভিন্ন রাজবংশের কাল পরস্পরা নির্ণয়ে মুদ্রার গুরুত্ব অপরিসীম।

   উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রায় সন তারিখ থেকে বোঝা যায়, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ৪০৯-৪১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। 

   প্রথম কুমার গুপ্তের রাজত্বের সূচনায় নিশ্চিত তারিখ ৪১৫ খ্রিষ্টাব্দ এ থেকে বোঝা যায়, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের পরবর্তী শাসক প্রথম কুমার গুপ্ত।


৩) ব্যক্তিগত কৃতিত্বের পরিচয় দেয়:-

   মুদ্রা বিভিন্ন বংশের রাজাদের ব্যক্তিগত কৃতিত্বের ও পরিচায়ক। যেমন সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রায় বিনাবাদনরত মূর্তি তাঁর সংগীত বিদ্যার পারদর্শিতার পরিচয় দেয়।


৪) ধর্মনীতির পরিচায়ক:-

   মুদ্রায় খোদিত বিভিন্ন ধরনের দেবদেবীর মূর্তি থেকে বিভিন্ন সময়কার রাজাদের ধর্মীয় নীতির পরিচয় মেলে, যেমন-

   ক) বিম্ কদ্ ফিসের মুদ্রায় ব্যবহৃত "মহেশ্বর” কথাটি থেকে মনে করা সম্ভব হয় যে, তিনি শৈব ছিলেন।

   খ) কনিষ্কের কিছু মুদ্রায় বুদ্ধদেবের নাম ও মূর্তি থাকায় কনিষ্ক বৌদ্ধ ছিলেন এ কথা জানা যায়।

   গ) গুপ্ত শাসকদের মুদ্রায় লক্ষ্মী ও কার্তিকের মূর্তি খোদিত থাকায়, ওই সমস্ত দেবদেবীর প্রতি তাদের আসক্তি প্রমাণিত হয়।


৫) বাণিজ্যিক সম্পর্ক বোঝা যায়:-

   এক দেশের মুদ্রা অপর দেশে পাওয়া গেলে উভয় দেশের মধ্যেকার বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়ে অনুমান করা যায়, যেমন:-

   ক) কুষাণ যুগে ও শখ সাতবাহন আমলে রোম তথা পাশ্চাত্যের সঙ্গে ভারতবর্ষের যে সমৃদ্ধশালী বাণিজ্য চলত তা ভারতে প্রাপ্ত ওই সময়ের অসংখ্য রোমান মুদ্রা থেকে সমর্থিত হয়।


৬) জয়-পরাজয়ের সাক্ষ্য দেয়:-

   কখনো কখনো এক রাজার জয়লাভ বা অন্যজনের পরাজয়ের সাক্ষ্য দেয় মুদ্রা, যেমন:-

   ক) জোগালথাম্বিতে  প্রাপ্ত নহপালের মুদ্রায় তাঁর নাম কেটে ফেলা হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা হয়, সাতবাহন রাজ্য গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী নহপালকে (১২৪-১২৫ খ্রিস্টাব্দে) পরাজিত করেন।


৭) শাসকদের পরিচায়ক:-

   রাজার নাম, তাঁর বংশ পরিচয়, শাসন ব্যবস্থা রাজ্যসীমা এবং রাজনীতির পরিচয় মেলে মুদ্রা থেকে, যেমন:- দ্বিতীয় ও প্রথম খ্রিস্টপূর্বাব্দে আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজত্বকারী "ইউথিডেমাস” "প্যান্টালিয়ন” প্রমুখ ৩০ জন ব্যাকট্রিক গ্রিক শাসকদের ইতিহাস মুদ্রা থেকেই জানা যায়।

৮) রাজ্য সীমানা নির্ধারণ:-

   মুদ্রার প্রাপ্তিস্থান থেকে রাজ্য বা রাজবংশের রাজ্যসীমা সম্পর্কে জানা যায়।


৯) শিল্পের ধারণা দেয়:-

   প্রাচীন ভারতের মুদ্রা গুলি প্রধানত সিসা, কাঁসা, তামা, রুপা, সোনা দিয়ে তৈরি। এ থেকে সেই যুগের ধাতব শিল্পের ধারণা পাওয়া যায়।


১০) শিল্পকলার ধারণা দেয়:-

   প্রাচীন ভারতীয় স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা গুলি থেকে প্রস্তুতকারকের শিল্প নৈপুণ্য ও সৌন্দর্য জ্ঞানের পরিচয় পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।


১১) অস্পষ্ট ধারণা স্পষ্টতর করে:-

   কোন কোন সময় অন্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য কোন ঘটনার স্পষ্ট প্রমাণ দিতে অপারগ হয়। মুদ্রার সাহায্যে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেমন:-

   ক) পশ্চিম ভারতে শকদের বিরুদ্ধে গুপ্ত শাসক দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের জয়লাভের ঘটনা। মধ্যপ্রদেশের ভিলসার নিকটবর্তী উদয়গিরিতে প্রাপ্ত তাঃর দুটি লেখ এবং সাঁচীর লেখটি শকদের বিরুদ্ধে তাঁর যুদ্ধযাত্রার আভাস দেয় সত্য।তবে এর ফল কি হয়েছিল সে সম্পর্কে এগুলি নীরব। 

  কিন্তু পশ্চিম ভারতে শক শাসকদের অনুকরনে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত আনুমানিক ৪০৯-৪১৫ খ্রিস্টাব্দে যে মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন তা অনেকটা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, এই যুদ্ধে তিনি সফল হয়েছিলেন। আবার ওই মুদ্রাগুলি তারিখ সম্বলিত হওয়ায় গুপ্ত শাসক তাঁর রাজত্বকালের শেষ দিকে শকদের পরাজিত করে উজ্জয়িনী ও পশ্চিম ভারতের গুপ্ত শাসন যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

   খ) শুধু তাই নয়, সাঁচী লেখর ভিত্তিতে জানা যায় যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বের শেষ নিশ্চিত তারিখ ৪১২-৪১৩ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু উক্ত মুদ্রাগত তথ্য থেকে অনুমান করা অসম্ভব নয় যে, ওই তারিখের পরেও তিনি দু’-এক বছর শাসন করেছিলেন। পরবর্তী শাসক প্রথম কুমারগুপ্ত রাজত্বের সূচনার নিশ্চিত তারিখ ৪১৫ খ্রিস্টাব্দ হওয়ায় এ অনুমান স্পষ্টতর হয়। 


১২) সমসাময়িক কালের পোশাক পরিচ্ছদ ও অলংকারের ধারণা দেয়:-

   মুদ্রার উপর অঙ্কিত বিচিত্র চিত্র থেকে সমসাময়িক কালে ব্যবহৃত পোশাক-পরিচ্ছদ, অস্ত্রশস্ত্র ও অলংকার সম্বন্ধে আকর্ষণীয় তথ্য পাওয়া যায়।


মুদ্রার সীমাবদ্ধতা:-

   মুদ্রা থেকে এত সব কিছু জানা গেলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেগুলি হল:-

১) প্রাপ্তিস্থান জনিত সমস্যা:-

   বাণিজ্যিক সূত্রে এক দেশের মুদ্রা অন্য দেশে পাওয়া যেত। তাই মুদ্রার প্রাপ্তির স্থান, মুদ্রা প্রস্তুতকারী রাজার অধিকারে ছিল বলা যায় না।

২) সম্যক তথ্যের অভাব:- 

   লিপির প্রাপ্তিস্থান থেকে যেমন সেই দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সংস্কৃতির আভাস মেলে, মুদ্রা থেকে তা সেভাবে মেলে না।

৩) অনুকরণ জনিত সমস্যা:-

   মুদ্রায় অনুকরণ জনিত প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রার আদলে বাংলায় ষষ্ঠ- সপ্তম শতকে নিকৃষ্টমানের মুদ্রার প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।


৪)  পাঠোদ্ধারের সমস্যা:- 

   অনেক সময় মুদ্রাতে রাজার নামের স্পষ্ট উল্লেখ থাকে না, ফলে সঠিক পাঠোদ্ধার করা যায় না।

৫)  ব্যাখ্যা নিয়ে মতপার্থক্য:-

   অনেক সময় মুদ্রায় যে ছবি উৎকীর্ণ থাকে তার ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। প্রথম কুমারগুপ্তের "অপ্রতীঘ” শ্রেণীর মুদ্রার ব্যাখ্যা নিয়ে এই সমস্যা দেখা দেয়।


মন্তব্য:-

   প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান গুলির মধ্যে লিপির শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়ে বলা যেতে পারে, লিপি হল ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। ডক্টর ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথের মতে- "প্রশ্নাতীতভাবেই লিপি হলো ভারত ইতিহাসের সর্বাধিক পর্যাপ্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ উৎস।"

Post a Comment

2 Comments