Ticker

6/recent/ticker-posts

চার্টার অ্যাক্ট সনদ আইন (১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দ)


পটভূমি:-

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতি কুড়ি বছর অন্তর নতুন সনদ নেওয়ার নীতি প্রচলিত ছিল। তাই সনদ আইন নবীন করণের জন্য পার্লামেন্টে উপস্থাপিত হয়। এবং "চার্টার অ্যাক্ট” বা "সনদ আইন (১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দ)” নামে এক আইন পাস করে। 

   ইংরেজ কোম্পানি অন্যতম কর্তা চার্লস গ্রান্ট (Charles Grant) এবং তাঁর সহযোগী উইলিয়াম উইলবারফোর্স(William Wilberforce) মনে করতেন যে, হিন্দু সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত করার দায়িত্ব ইংরেজ কোম্পানিকে নিতে হবে এবং তার জন্য চাই খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও ইংরেজি শিক্ষা। এইকাজে ইংরেজ কোম্পানির উৎসাহ ও আনুকূল্য আবশ্যক।


সনদ আইনের  বিষয়বস্তু:-

ক) ভারতবাসীর জন্য শিক্ষা বিস্তার। 

খ)  প্রচলিত ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবর্তন।

১) ভারতবাসীর জন্য শিক্ষা বিস্তার:-

ভারতবাসীর শিক্ষা বিস্তারের জন্য সনদআইনের প্রস্তাব  হল  i) রাজস্ব ভান্ডার থেকে অর্থ ব্যয়:- সনদ আইনে শিক্ষা বিস্তারে আগ্রহী প্রাচ্যবাদী এবং পাশ্চাত্য বাদী উভয় পক্ষের মতামত গৃহীত হয়।

    উভয়পক্ষকে খুশি করার উদ্দেশ্যে সনদ আইনের ৪৩ নং ধারায় বলা হয় যে- সাহিত্যের পুনর্জীবন ও উন্নয়ন দেশীয় শিক্ষিত ব্যক্তিদের উৎসাহদান এবং ব্রিটিশ ভারতীয় অধিবাসীদের বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য ও উন্নয়নের জন্য কোম্পানির রাজস্ব ভান্ডার থেকে প্রতিবছর এক লক্ষ টাকা খরচ করতে হবে।


শিক্ষা বিস্তারে সনদ আইনের গুরুত্ব:-

১) কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণ:-সনদ আইনে নির্দেশের ফলে কোম্পানি ভারতীয়দের শিক্ষার দায়িত্ব নিতে শুরু করে। শিক্ষাখাতে প্রতিবছর এক লক্ষ টাকা ব্যয় করে কোম্পানি। এর আগে কোম্পানি শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা করলেও শিক্ষা বিস্তার যে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব,তা স্বীকার করেননি।

২) কমিটি গঠনের নির্দেশ:-সনদ আইনের ৪৩ নং ধারাকে কার্যকরী করার জন্য একটি নিজস্ব কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়।

৩) সরকারি অনুদান প্রথা চালু:- দেশীয় শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম সরকারি অনুদান দেওয়ার প্রথা চালু হয়।

৪) শিক্ষা বিস্তারে মিশনারীদের বাধা অপসারণ:- সনদ আইনে মিশনারিদের শিক্ষা প্রসারের সমস্ত বাধা অপসারিত হয়। তারা দলে দলে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে ভারতে আসতে শুরু করে এবং অধিক ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো সুদৃঢ় করে।

৫) ভারতীয় শিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন:-১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন আধুনিক ভারতীয় শিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। শুরু হয়েছিল পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা।

৬) ইংরেজি ভাষার স্বীকৃতি:- এই সনদ আইনে পাশ্চাত্য শিক্ষা, বিশেষ করে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

৭) এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন উদ্যোগ:-এই সনদ আইনে শিক্ষাধারা গৃহীত হওয়ার ফলে দেশে তিন ধরনের উদ্যোগ দেখা দেয়। সেগুলো হলো-i)  সরকারি উদ্যোগ।

ii) বেসরকারি ভারতীয় ও ইউরোপীয় দলের উদ্যোগ। এবং

iii) মিশনারীদের উদ্যোগ

৮) শিক্ষার ওপর থেকে সরকারি হস্তক্ষেপ হ্রাস সম্পর্কিত আইন শিক্ষাক্ষেত্রে শুভ সূচনার ইঙ্গিত বহন করে।


শিক্ষা বিস্তারে সনদ আইনের  ত্রুটি:-

১) সনদ আইনে প্রাচ্য না পাশ্চাত্য সাহিত্যের পুনর্জীবনের ও উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে তা পরিষ্কার নয়।

২) প্রাথমিক শিক্ষার জন্য অর্থসংস্থান সম্পর্কে অস্পষ্টতা  ছিল, যার ফলে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার ব্যাহত হয়।

৩) আইনে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর জোর দিলেও একে অবৈতনিক, সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করা যায় নি।

৪) মুসলিমদের জন্য বিশেষ শিক্ষা পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িকভাবে উৎসাহ দিয়েছিল।

৫) সনদ আইনে প্রাচ্য না পাশ্চাত্য কোন ধরনের বিজ্ঞান শিক্ষার প্রবর্তন  উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে, সেই বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়।

৬) কোন ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হবে এই আইনে তাও পরিষ্কার নয়।

শিক্ষা বিস্তারে সনদ আইনের  ফলাফল:-

১) শিক্ষার ওপর থেকে সরকারি হস্তক্ষেপ হ্রাস সম্পর্কিত আইন শিক্ষাক্ষেত্রে শুভ সূচনার ইঙ্গিত বহন করে।

২) স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কে প্রাথমিক শিক্ষার ভার অর্পণ করার মধ্য দিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন।

৩)  সহকারী ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিদ্যালয় শিক্ষা পর্যন্ত সাহায্য করেছিল।

৪) সনদ আইনে প্রাচ্য না পাশ্চাত্য কোন সাহিত্যের উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে তা পরিস্কার না হওয়ায় রাজ্য এবং পাশ্চাত্য বাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

) ইংরেজি ভাষা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

৬) সনদ আইনে মিশনারিদের শিক্ষা প্রসারের সমস্ত বাধা দূরীভূত হয়। তারা দলে দলে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসতে শুরু করে এবং অধিক ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার বুনিয়াদ কে আরো সুদৃঢ় করে।


মন্তব্য:-

সনদ আইন কে ভারতের শিক্ষা ক্ষেত্রে এক যুগের অবসান ও অপর এক যুগের প্রারম্ভ বলে ধরা হয়ে থাকে। 

 (ক) এই সনদের ধারা গ্রান্ট ও উইলবার ফোর্সের আন্দোলনের সমাপ্তি হয়। ভারতের অধিবাসীদের শিক্ষাদান কোম্পানির মধ্যে ধার্য হয় এবং বছরের নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় বাধ্যতামূলক।


খ) প্রচলিত ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবর্তন:-

পটভূমি:-দীর্ঘদিন ধরে নেপোলিয়োনিক  যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় মহাদেশীয় ব্যবস্থার কার্যক্রম ব্রিটিশ বাণিজ্যে হ্রাস পায়। ১৮১৩খ্রিস্টাব্দে সনদ আইনের পুনর্নবীকরণের সময়ে ব্রিটিশ পুঁজিপতি কোম্পানিগুলি সকলেই ভারতে বাণিজ্য করার অধিকার দাবি করে।


আইন পাস:-

সনদ আইনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ভারতীয় বাণিজ্যের অধিকার লুপ্ত হয় এবং ইংল্যান্ডের সমস্ত বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলির জন্য ভারতীয় বাজার উন্মুক্ত হয়।


ফলাফল:-

১) ইংল্যান্ডের সমস্ত বাণিজ্যিক কোম্পানী গুলির জন্য ভারতীয় বাজার উন্মুক্ত হয়।

২)  ভারতীয় শিল্প বাণিজ্য গুলি অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়।

৩)  ভারতীয় শিল্প বাণিজ্যের অবনতি ঘটে।

৪)  ভারত কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়।

৫) ভারতীয় বাজার গুলি ব্রিটিশ পণ্য বিক্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়।

৬)  ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে ভারতে উন্নত সড়ক তৈরি হয়।

৭)  রেলপথের বিস্তার ঘটে।

৮) রেলপথের  সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসার উন্নতি ঘটে।

Post a Comment

0 Comments