Ticker

6/recent/ticker-posts

সাইমন কমিশন



পটভূমি:-

   অসহযোগ আন্দোলনের প্রাক্কালে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে "মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার" আইন প্রণীত হয়। কথা ছিল, প্রতি দশ বছর অন্তর এই আইনের কার্যকারিতা লক্ষ্য করার জন্য একটি পর্যবেক্ষক দল ভারতে আসবে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহারের পর ভারতের জাতীয় আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, মুসলিম লীগের আন্দোলন ক্রমশ সাম্প্রদায়িক দিকে মোড় নিতে থাকে। শাসনতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য ভারতবাসীর ক্রমবর্ধমান দাবি ব্রিটিশ সরকারকে বিচলিত করে। সরকার বুঝতে পারে যে, ভারতবাসীকে সাংবিধানিক অধিকার প্রদান করে সন্তুষ্ট না করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।


সাইমন কমিশন গঠন:-

   ইংরেজ সরকার ভীত হয়ে ১০ বছরের মেয়াদ শেষ হবার আগেই ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সর্বদলীয় ৭ জন সদস্য নিয়ে একটি কমিশন গঠন করে। খ্যাতনামা ব্রিটিশ আইনজীবী ও উদারপন্থী দলের(Liberal Party) সাংসদ "স্যার জন সাইমন” এই কমিশনের নেতা হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় কমিশনটি "সাইমন কমিশন” নামে খ্যাত। কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে দুজন ছিলেন শ্রমিক দলের(Labour Party) এবং বাকি চারজন রক্ষণশীল দলের(Conservative party)।

   এইভাবে যে কমিশন ভারতীয়দের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের জন্য গঠন করা হল, তাতে একজনও ভারতীয় কে গ্রহণ করা হলো না। কেবলমাত্র শ্বেতাঙ্গ সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয়। যৌক্তিকতা হিসেবে বলা হয়, এটি একটি পক্ষপাতহীন সাংসদীয় কমিশন। তাই এই কমিশনে ভারতীয় সদস্য নেওয়ার কোন উপায় নেই।


সাইমন কমিশনের উদ্দেশ্য:-

 ১) মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার(১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ) আইনের কার্যকারিতা বিচার।

২)  ভারতীয়দের প্রশাসনিক যোগ্যতার মূল্যায়ন।

৩)  ভবিষ্যতের জন্য কতটুকু শাসন সংস্কার প্রয়োজন তা নির্ধারন করা।


ভারতীয়দের ক্ষোভের কারণ:-

 ১) ভারতের সংবিধান রচনা এবং ভারত, সরকার গঠনের উপযুক্ত কিনা তা বিচার করার জন্য গঠিত কমিশনের একজন ও ভারতীয় সদস্য ছিলেন না,- এই বিষয়টিকে "জাতীয় অপমান” হিসেবে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং বামপন্থী সহ সমস্ত রাজনৈতিক দল মনে করে এবং ক্ষুব্দ হয়ে ওঠে।

২) ভারতীয় জনমত উপেক্ষা করে শুধুমাত্র বিদেশি সদস্যদের দ্বারা গঠিত কমিশন কে ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পাঠানো হয়।


ভারতীয় জনগণের প্রতিক্রিয়া:-

  ১) কমিশন কে বর্জন করার শপথ:- সাইমন কমিশনে কোন ভারতীয় সদস্য গ্রহণ না করায় একে "জাতীয় অমর্যাদা” বলে মনে করেন কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং বামপন্থী সহ সমস্ত রাজনৈতিক দল। সাইমন কমিশন কে সামাজিক ও রাজনৈতিক সর্বতোভাবে বর্জন করার শপথ গ্রহণ করে।


২) বোম্বাইতে আন্দোলন:- ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ৩রা ফেব্রুয়ারি "জন সাইমন"  বোম্বাইতে এলে ওই দিন সারা ভারতে হরতাল পালিত হয়। হাতে কালো পতাকা ও "Go back Simon”  লেখা প্রচারপত্রসহ সর্বত্র বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। অসংখ্য জনসভার মধ্যে বোম্বাইয়ের চৌপাটি বালিয়াড়ির সমাবেশটি ছিল সবচেয়ে বড়।

তখন বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দার ফলে ভারতেও ব্যাপক শ্রমিক ছাঁটাই, বেকারত্ব, কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন হ্রাস, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতি শ্রমিক অসন্তোষ প্রকট হয়ে পড়ে। ফলে তারাও এই আন্দোলনে যুক্ত হয়।

   শুধুমাত্র বোম্বে ৫০,০০০ শ্রমিক এই  আন্দোলনে মিলিত হয়েছিল। কংগ্রেসের নেতৃত্বে এবং কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগীতায় ভারতের জনগণ এই আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। কংগ্রেসের গোবিন্দ বল্লভ পন্থ, জহরলাল নেহেরু, "সাইমন কমিশন” বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের হাতে প্রচন্ডভাবে প্রহৃত হয়েছিলেন।

৩) লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বদান:- ৩০ শে অক্টোবর লাহোরে সাইমন কমিশন বিরোধী শোভাযাত্রার উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে। মিছিলের পুরোভাগে থাকাকালে বৃদ্ধ জননেতা "লাজপত রায়", মাথায় পুলিশের লাঠির আঘাতে দারুণভাবে আহত হন এবং কয়েকদিন পর (১৭ ই নভেম্বর) মৃত্যুমুখে পতিত হন।

৪) যুক্তপ্রদেশে  আন্দোলন:- যুক্তপ্রদেশ (বর্তমান উত্তর প্রদেশ) মতিলাল নেহেরুর পুত্র জহরলাল, গোবিন্দ বল্লভ পন্থ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ শোভাযাত্রা পরিচালনার সময় পুলিশের হাতে প্রহৃত হন।

৫) কলকাতায় অরন্ধন ও ধর্মঘট পালন:- সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে কলকাতায় "অরন্ধন" "ধর্মঘট" পালিত হয়। সাইমন বিরোধী আন্দোলনে দেশের ছাত্র ও যুব সমাজ এক বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করে।


সাইমন রিপোর্ট পেশ:-

    প্রায় দু'বছর ধরে এই আন্দোলন চলেছিল এবং এত ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যেও কমিশন ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তার রিপোর্ট পেশ করে।


ফলাফল:-

১)  সাইমন কমিশনের সুপারিশের উপর নির্ভর করে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে "ভারত শাসন” আইন রচনা করা হয়।

২)  দেশজুড়ে ব্রিটিশ বিরোধী মঞ্চ গড়ে তুলে আইন অমান্য আন্দোলনের পটভূমি নির্মিত হয়।

৩)  ব্রিটিশ সরকার সংবিধান রচনার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের যোগ্যতা নিয়ে কটাক্ষ করায় কংগ্রেস নেতৃত্ব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়। "মতিলাল নেহেরু" এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে  সংবিধানের খসড়া রিপোর্ট প্রস্তুত করেন,যা "নেহেরু রিপোর্ট" নামে খ্যাত।

৪)  এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হিন্দু- মুসলমান, ধনী-নির্ধন, শ্রমিক-কৃষক, শিক্ষিত অশিক্ষিত, নির্বিশেষে যেভাবে মিলিত হয়েছিল তা পরবর্তীকালে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয়েছিল।


মন্তব্য:- 

    জাতীয় অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন এক আলোর দিশা দেয়। কংগ্রেস সহ সব রাজনৈতিক দল সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে জাতীয় আন্দোলনের ভাবধারা কে উদ্দীপ্ত করে তোলে।

Post a Comment

0 Comments