Ticker

6/recent/ticker-posts

রাওলাট আইন (১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি)


পটভূমি:-

   ১)  ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানে পরে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বেকারত্ব, অনাবৃষ্টি প্রভৃতি কারণে ভারতীয়রা প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই ক্ষোভ ধীরে ধীরে গণ আন্দোলনে রূপ নেয়।

   ২) দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষ:- দক্ষিণ আফ্রিকার অনাবাসী ভারতীয়দের প্রতি শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বৈরী আচরণে ভারতীয়রা অসন্তুষ্ট হয়।

   ৩)  মুসলিমদের ক্ষোভ:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক পরাজিত হয়। ব্রিটিশ সরকারের মদতে তুরস্ক বিচ্ছিন্ন হলে ভারতীয় মুসলমানরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

   ৪) চরমপন্থীদের সক্রিয়তা:- এই সময় ভারতে নতুন করে বিপ্লবী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে।


রাওলাট কমিটি:-

    ১৯১৭ সালে ভারত সরকার পাঁচ সদস্যের এক কমিটি গঠন করে।  এই কমিটি "সিডিশন কমিটি(Sedition Committee)” নামে পরিচিত। ইংল্যান্ডের বিচারপতি "স্যার সিডনি রাওলাট(Sir Sydney Rowlatt)” ছিলেন এই কমিটির সভাপতি। এই কারণে কমিটিটি রাওলাট কমিটি নামেও পরিচিত।


রাওলাট কমিটির উদ্দেশ্য:-

   ১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ভারতে রাজদ্রোহীতা(Sedition) এবং বৈপ্লবিক কার্যকলাপের প্রকৃতি ও প্রসার নিরূপণ করা।

   ২)  বৈপ্লবিক আন্দোলন দমনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সম্বন্ধে সুপারিশ করা।

   এই দুটি কাজের জন্য ভারত সরকার ১৯১৭ সালে রাওলাট কমিটি গঠন করে।


রাওলাট আইন:- 

   ১৯১৮ সালের এপ্রিল মাসে রাওলাট কমিটি তার প্রতিবেদন পেশ করে। ১৯১৯ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি কমিটির সুপারিশ গুলি আইন রূপে গৃহীত হয়। এই আইনই রাওলাট আইন নামে কুখ্যাত।

   রাওলাট আইনের প্রকৃত নাম "দ্যা অ্যানার্কিক্যাল  এন্ড রেভল্যুশনারি অ্যাক্ট(The Anarchical and Revolutionary Act)”।


রাওলাট আইনের শর্ত:-

   ১)  সরকার বিরোধী যে কোন সভা সমিতি ও প্রচার দণ্ডনীয় অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে।

   সরকার সন্দেহ বসে যে কোন ব্যক্তিকে বিনা প্ররোচনায় গ্রেপ্তার এবং বিনা বিচারে আটক ও নির্বাসন দিতে পারবে।

   ৩)  অভিযুক্ত ব্যক্তির উচ্চতর আদালতে আপিলের  অধিকার, এমনকি আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আইনজীবী নিয়োগের অধিকার থাকবে না।

   ৪) উকিল বা সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই বিচারকার্য চলতে পারবে।

   ৫) সরকার বিরোধী যেকোনো প্রচারমূলক কাজই দণ্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

   ৬)  সন্দেহভাজন কোন ব্যক্তিকে আগাম সতর্কতা না জানিয়ে গ্রেপ্তার ও আটকে রাখা যাবে।

   ৭) অপরাধীদের বিশেষ আদালতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার করা হবে।

   ৮)  গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বিনা বিচারে দুই বছর পর্যন্ত আটকে রাখা যাবে।

   ৯)  কোনরকম সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই বিচারকরা বিচার চালাতে পারবেন।

   ১০)  সরকার বিনা পরোয়ানায় যে কোন ব্যক্তির গৃহ তল্লাশি করতে পারবেন।

   ১১) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করার ব্যবস্থা নেওয়া।

   এক কথায় এই নগ্ন দমনমূলক আইন জারি করার ফলে ভারতবাসীর ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা।


রাওলাট আইনের উদ্দেশ্য:

   রাওলাট আইন ছিল একটি দমনমূলক আইন। এই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ছিল-

   ১) ভারতীয়দের ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করা।

   ২) রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের অধিকার থেকে ভারতীয়দের বঞ্চিত করা এবং

   ৩)  ভারতবর্ষে সমস্ত রকম ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপ, বিপ্লবী কার্যকলাপ ও রাজনৈতিক আন্দোলন দমন করা।


রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশবিরোধী প্রতিক্রিয়া:-

   ১) গান্ধীজীর প্রতিক্রিয়া:- ঘৃণিত এই কালা আইন এর তীব্র প্রতিবাদ করে বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডকে তা কার্যকর না করার অনুরোধ জানিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে গান্ধীজী এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য ভারতব্যাপী সত্যাগ্রহ আন্দোলনের আহ্বান জানান। স্থির হয় ১৯১৯ সালের ৬ ই এপ্রিল সারাদেশে হরতাল দিবস হিসেবে পালিত হবে। গান্ধীজীর এই আহ্বানে অভাবনীয় সাড়া পাওয়া গেল। অনুষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সর্বভারতীয় ধর্মঘট। সেই সঙ্গে এই হরতালের বিপুল সাফল্যের মধ্য দিয়ে ভারতবাসী গান্ধীজিকে জাতীয় নেতা হিসাবে বরণ করে নেয়।

   ২) জিন্নাহর প্রতিক্রিয়া:- জিন্না এই আইনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, "ন্যায় বিচারের মূল আদর্শ ধ্বংস করা হয়েছে এবং যে সময়ে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই তখনই জনগণের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেয়া হল।” মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মদনমোহন মালব্য, মাজহার-উল- হক সহ চার জন এই আইন পরিষদের সদস্য পদে ইস্তফা দেন।

   ৩) পত্রপত্রিকার প্রতিক্রিয়া:- দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র এই দমনমূলক আইনের কঠোর সমালোচনা করে। মাদ্রাজের "নিউ ইন্ডিয়া”, "হিন্দু”, লাহোরের "পাঞ্জাবি”, বোম্বের "বোম্বাই” প্রভৃতি সংবাদপত্রে রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। "অমৃতবাজার” পত্রিকা এই আইনকে এক "ভয়ানক ভ্রান্তি” এবং তিলকের "কেশরী” পত্রিকা "অত্যাচার ও উৎপীড়নের দানবীয় যন্ত্র” বলে অভিহিত করে।

   ৪) আইনসভার সদস্যদের প্রতিক্রিয়া:- কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রতিটি বেসরকারি ভারতীয় সদস্য এই আইনের বিরোধিতা করেন। রাওলাট আইনের প্রতিবাদে বি.ডি. মুকুল আইনসভার সদস্য পদ বর্জন করেন।

   ৫) সারা দেশবাসীর প্রতিক্রিয়া:- রাওলাট আইনকে কেন্দ্র করে গান্ধীজীর আহ্বানে যে প্রচন্ড গণ আন্দোলনে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, ব্রিটিশ সরকার গুলির বিনিময়ে তাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করে। ফলে দিল্লি, লাহোর, গুজরানওয়ালা, কাসুর, অমৃতসর প্রভৃতি স্থানে হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু হয়। রাওলাট আইনের প্রতিবাদে যে রাওলাট সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয় তার মর্মান্তিক পরিণতি ঘটে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডে।

   ৬) ভারত সচিবের প্রতিক্রিয়া:- ভারত সচিব রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বড়লাটকে অভিযোগের সুরে লেখেন- "পৃথিবীর প্যাটল্যান্ডদের বা ওডায়ারদের মতো কোনো লোক কে বিনা বিচারে বন্দি করার সুযোগ করে দিতে আমি ঘৃণা করি।”

Post a Comment

0 Comments