Ticker

6/recent/ticker-posts

মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার বা ভারত শাসন আইন (১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ)



পটভূমি:-

১) মর্লে- মিন্টো শাসন সংস্কারের ব্যর্থতা:হাজার ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের মর্লে- মিন্টো শাসন সংস্কার ভারতীয়দের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।

২) হোমরুল আন্দোলনের জনপ্রিয়তা:-হোমরুল আন্দোলনের জনপ্রিয়তার প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে যে, কেবল দমননীতি দ্বারা ভারতবাসীর জাতীয়তার দাবিকে নস্যাৎ করা যাবে না।

৩) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব:- প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহে ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর সহযোগিতার প্রয়োজন উপলব্ধি করে।

৪) আইন প্রণয়ন:- ভারতীয়দের সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট ভারত সচিব "এডুইন মন্টেগু(Eduin Montagu)” ঘোষণা করেন, প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ অবসানের পর ভারতকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া হবে। সরকারিভাবে ঘোষিত এই নীতি "মন্টেগু ঘোষণা" নামে পরিচিত। 

  সেই সময় ভারতের বড়লাট ছিলেন "লর্ড চেমসফোর্ড(Lord Chelmsford)” মন্টেগু ও চেমসফোর্ডের যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে এক রিপোর্ট পেশ করেন(১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে)। তারই নাম ভারত শাসন সংক্রান্ত প্রতিবেদন। লোকমুখে সেটি "মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপোর্ট” নামে পরিচিত। 

  ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয় তাঁদের যৌথ সংস্কার প্রস্তাব এবং এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে  পাস হয় ভারত শাসন আইন। সংক্ষেপে এই আইনটি মন্টফোর্ড সংস্কার(Montford Reforms) নামেও পরিচিত। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই আইন চালু হয়।


মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারের প্রস্তাবিত বিষয়:-

১) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন:- 

এই আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।

ক) কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে থাকে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র, ডাক, রেল, মুদ্রা, বাণিজ্য, সরকারি ঋণ, অন্যান্য সংযোগ ব্যবস্থা, দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন ব্যবস্থা, সর্বভারতীয় প্রশাসনিক চাকরি ইত্যাদি।

খ) প্রাদেশিক সরকারের অধীনে থাকে আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলার দায়িত্ব, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা,স্বাস্থ্য, কলকারখানা ও শ্রমিকদের অবস্থা, কৃষি ও জলসেচ, রাস্তাঘাট, দুর্ভিক্ষ মোচন, জমির খাজনা, শুল্ক, সমবায় সমিতি, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদি দেখাশোনা করার দায়িত্ব। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের আয় ব্যয়ের ব্যবস্থা  ও পৃথক করে দেওয়া হয়।

) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহক পরিষদ:-

কেন্দ্রে ভাইসরয়ের কার্যনির্বাহক পরিষদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। পূর্বের(১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ) একজনের পরিবর্তে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের আইনে তিনজন ভারতীয় সদস্য নেওয়া হয়।

  উল্লেখ্য ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের আইনের ফলে "সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ” বড়লাটের কার্যনির্বাহক পরিষদের একমাত্র ভারতীয় সদস্য নিযুক্ত হয়েছিলেন।

৩) কেন্দ্রীয় আইনসভা ও সদস্যসংখ্যা কেন্দ্রীয় আইনসভা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট- ক) উচ্চকক্ষের নাম রাজ্যসভা। খ) নিম্নকক্ষের নাম আইনসভা।

   রাজ্যসভায় ৬০ জনের বেশি সদস্য থাকবেন না। তাদের মধ্যে ৩৪ জন হবেন নির্বাচিত সদস্য; তাছাড়া ২০ জনের অধিক সরকারি সদস্য রাজ্যসভায় স্থান পাবেন না। নিম্নতর সভা বা আইন সভায় থাকবেন ১৪০ জন সদস্য। পরে ঐ সংখ্যা বাড়িয়ে ১৪৫ করা হয়। এঁদের মধ্যে ১০৫ জনই হবেন নির্বাচিত; ২৬ জন থাকবেন মনোনীত সরকারি সদস্য এবং ১৪ জন মনোনীত বেসরকারি সদস্য।

৪) কেন্দ্রে বিচার ব্যবস্থা:-

আগেকার পরোক্ষ নির্বাচন প্রথা তুলে দেওয়া হল। কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচিত সদস্যরা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নিযুক্ত হবেন, এই স্থির হল। তবে সবাইকে ভোটদানের অধিকার দেওয়া হল না, সম্পত্তির ভিত্তিতে ভোটাধিকার সীমাবদ্ধ রইল বিশেষ ধনী ব্যক্তিদের হাতে।


৫) কেন্দ্রীয় আইনসভার সীমাবদ্ধ ক্ষমতা:-

কেন্দ্রীয় আইনসভার হাতে বিস্তর ক্ষমতা দেওয়া হলেও বড়লাটের হাতে রইল গণ্ডি টানার ক্ষমতা। যেমন উচ্চতর রাজ্যসভার ও নিম্নতর আইন সভার স্থায়িত্বকাল ছিল যথাক্রমেবছর আরবছর। কিন্তু বড়লাট এই কার্যকাল শেষ হবার আগেই আইনসভা ভেঙে দিতে পারতেন। কেন্দ্রে বড়লাটের ক্ষমতা আগের মতোই রয়ে গেল। তাঁকে জবাবদিহি করতে হত সরাসরি ভারত সচিব ও পার্লামেন্টের কাছে, ভারতীয় আইন সভার কাছে নয়।

   আইনসভার হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দিলেও কয়েকটা বিষয়ে আইন করতে গেলে বড়লাটের অনুমতি নিতে হত। জরুরি অবস্থার অজুহাতে তিনি ছয় মাসের জন্য বিশেষ আইন(ordinance) জারি করতে পারতেন। অর্থনৈতিক বিষয়ক আইন সভার ক্ষমতাও বড়লাট নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং জরুরি অবস্থার সুযোগ নিয়ে আইনসভাকে অগ্রাহ্য করে তিনি যে কোন খরচ করতে পারতেন।


৬) প্রাদেশিক আইন সভার গঠন পদ্ধতি:-

প্রাদেশিক আইন সভার গঠনেও কেন্দ্রের মত কিছু পরিবর্তন আনা হল। প্রাদেশিক আইনসভা গুলি অবশ্য এক কক্ষ বিশিষ্ট(unicameral) রইল। তাদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেল, যেমন বাংলার আইন সভায় ১৩৯ (পরে ১৪০) জন সদস্যের জন্য আসন করা হলো স্থির হল,প্রাদেশিক আইন সভা গুলির মোট সদস্যের শতকরা ৭০ ভাগ নির্বাচিত হবেন, বাদবাকি হবেন সরকারের দ্বারা মনোনীত। 

  মনোনীত  সদস্যদের শতকরা ২০ ভাগের অধিক সরকারি ব্যক্তি হবেন না। প্রাদেশিক আইনসভা গুলিতে গোষ্ঠীগত ও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন ব্যবস্থা করা হল। অর্থাৎ জমিদার, বণিক, বিশ্ববিদ্যালয়, মুসলিম, শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এবং ইউরোপিয়ান ইত্যাদি পৃথক পৃথক প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন।

৭) প্রাদেশিক শাসনে দ্বৈত ব্যবস্থা:-

প্রাদেশিক শাসন পদ্ধতিতে দৈত্য ব্যবস্থা চালু হল। অর্থাৎ বেশ কয়েকটি বিষয়ে প্রাদেশিক আইন সভার তোয়াক্কা না করে প্রাদেশিক গভর্নর এবং তাঁর কার্যনির্বাহক পরিষদের অধিকার সংরক্ষিত রইল। এগুলিকে বলা হল "সংরক্ষিত বিষয়” যেমন- পুলিশ, বিচারব্যবস্থা, খাজনা, জলসেচ  বনরক্ষণ, দুর্ভিক্ষ-ত্রাণ এবং কল কারখানার শ্রমিকদের অবস্থা।  

  এসব সংরক্ষিত বিষয়ে অবশ্য প্রাদেশিক আইন সভা আলোচনা করতে পারত, তার বেশি কিছু নয়। অন্য কতকগুলি বিষয়ে আইন প্রণয়নের অধিকার প্রাদেশিক আইনসভার হাতে ছেড়ে দেওয়া হল। সেগুলিকে বলা হত "হস্তান্তরিত বিষয়” যেমন- স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পথঘাট নির্মাণ, শুল্ক ব্যবস্থা, সমবায় সমিতি এবং শিল্পোদ্যোগ। বাজেট পাশ করার ক্ষমতাও থাকল প্রাদেশিক আইনসভার হাতে। তবে প্রাদেশিক গভর্নর আইন সভাকে অগ্রাহ্য করে বিশেষ প্রয়োজনের অজুহাতে সংরক্ষিত বিষয়গুলির খাতে ব্যয় করতে পারতেন।

হস্তান্তরিত বিষয়গুলি নিয়ে কার্যনির্বাহের জন্য প্রাদেশিক গভর্নরের হাতে মন্ত্রিসভা গঠনের ভার দেওয়া হল। প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে মন্ত্রী নিয়োগ করা হত। তবে প্রাদেশিক আইনসভার কাছে মন্ত্রীদের কৈফিয়ৎ দিতে হত, অর্থাৎ আইনসভার কাছেই তাঁরা দায়িত্বশীল ছিলেন। কিন্তু সেটা কেবল নামে মাত্র। কেননা গভর্নর ইচ্ছে করলে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিতে পারতেন এবং হস্তান্তরিত বিষয় গুলির উপর মন্ত্রিসভার অধিকারেও হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল।


প্রতিক্রিয়া:-

 মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের প্রস্তাবে ভারতীয়দের দাবি মানা হয়নি। তাই ভারতীয়রা এই আইনের বিরোধিতা করে।

১) লোকমান্য তিলক এর প্রতিক্রিয়া:- লোকমান্য তিলক এই প্রস্তাব "বিবেচনার অযোগ্য” বলে প্রত্যাখ্যান করেন।

২) অ্যানি বেসান্তের প্রতিক্রিয়া:- শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত এই প্রস্তাবকে ব্রিটেন ও ভারতবর্ষ-উভয়ের পক্ষেই "অপমানকর” বলে মন্তব্য করেন।

(৩) জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া:- কংগ্রেসের এক বিশেষ অধিবেশন এই আইনকে "অপর্যাপ্ত”"অসন্তোষজনক” "হতাশাময়”  বলে অভিহিত করেন। কিন্তু অন্যদিকে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্তামণি, শ্রীনিবাস শাস্ত্রী, স্যার দীনশা ওয়াচা,তেজবাহাদুর সপ্রু, প্রমূখ কংগ্রেসের নরমপন্থী নেতৃবৃন্দ  মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার প্রস্তাব কে স্বাগত জানিয়েছিলেন।


 ভারতীয়দের হতাশার কারণ:-

  প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয়রা ব্রিটিশ সরকারকে অর্থ ও সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছিল এই আশা নিয়ে যে, "মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার” আইন তাঁদের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করবে। কিন্তু তা না করে বিভিন্ন প্রদেশে দ্বৈতশাসন ও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন পদ্ধতি প্রচলন করে দেয়। স্বভাবতই ভারতীয়রা প্রচন্ড হতাশ হয়ে পড়ে।

Post a Comment

0 Comments