পটভূমি:-
সাইমন কমিশনের সুপারিশ(১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ), গান্ধীজীর আইন অমান্য আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লন্ডনে অনুষ্ঠিত তিনটি গোলটেবিল বৈঠকের (প্রথম গোল টেবিল বৈঠক ১৯৩০ থ্রি স্টাফদের ১২ ই নভেম্বর, দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর থেকে ১লা ডিসেম্বর, তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে, নভেম্বর)। ফলশ্রুতি হল ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২রা আগষ্ট ব্রিটিশ সরকারের ভারত শাসন আইন।
আইনে প্রস্তাব:-
এই আইনে দুটি প্রস্তাব করা হয়,-
১) দেশীয় রাজ্যগুলি এবং (২) ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ নিয়ে একটি সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠন(All India federation)
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন:-
১) সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র:-
এই আইনে বলা হয়েছে- কেন্দ্রে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠন করা হবে। দেশীয় রাজ্ন্যবর্গ ইচ্ছে করলেই এই যুক্তরাষ্ট্রে যোগদান করতে পারেন। অর্থাৎ যোগদান ব্যাপারটা বাধ্যতামূলক নয়। ফলে সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র যে ঠিক কবে থেকে চালু হবে সেটা অনিশ্চিত রয়ে গেল। বলা হলো ১০৪ টি আসনে দেশীয় রাজ্যগুলির প্রতিনিধিত্ব না থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা বাতিল হবে। কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে
ক) কার্যনির্বাহক সভা এবং
খ) ব্যবস্থাপক বা আইন সভায় ভাগ করা হয়।
কর্যনির্বাহক সভা:-
যুক্তরাষ্ট্রীয় কার্যনির্বাহক সবার কাজ কর্ম দু'ভাগে ভাগ করা হয়।
i) বৈদেশিক নীতি, প্রতিরক্ষা, উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল শাসন ইত্যাদি বিষয় গুলি বড়লাটের হাতে রইল। এগুলিকে তাই বলা হতো "সংরক্ষিত বিষয়”। সংরক্ষিত বিষয়ে ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার কোন মতামত স্বীকার করা হলো না। বড়লাট এগুলির জন্য সরাসরি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে দায়ী রইলেন।
ii) অন্যান্য কাজ কর্মকে বলা হলো "হস্তান্তরিত বিষয়”। এগুলি পরিচালনার ব্যাপারে বড়লাট ও তাঁর মন্ত্রিসভা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপক সভার কাছে দায়ী থাকবেন। বলা হলো,
সাধারণ ব্যবস্থাপক সভার সদস্যের মধ্য থেকে বড়লাট তাঁর মন্ত্রীদের নিযুক্ত করবেন এবং তিনি খুশি থাকলে তাঁদেরও মন্ত্রিত্ব থাকবে। উপরন্তু হস্তান্তরিত বিষয়গুলি মন্ত্রিসভা দেখবেন বটে, তবে এখানেও বড়লাটের কিছু বিশেষ ক্ষমতা থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সমূহ স্বার্থরক্ষা, ব্রিটেনের বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষা ইত্যাদির অজুহাতে এই বিশেষ ক্ষমতা প্রযুক্ত হবে।
ব্যবস্থাপক বা আইনসভা:-
যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপক বা আইনসভা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট, যথা:-i) উচ্চতর কক্ষ, ii)নিম্নতর কক্ষ।
I) উচ্চতর কক্ষ:-
যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপক বা উচ্চতর কক্ষকে বলা হবে ,"রাজ্যসভা"। রাজ্যসভায় থাকবেন ব্রিটিশ-ভারতের ১৫৬ জন প্রতিনিধি এবং দেশীয় রাজ্য সমূহ থেকে অনূর্ধ্ব ১০৪ জন প্রতিনিধি। অর্থাৎ এখানে সদস্যদের চল্লিশ ভাগই হবেন রাজন্যবর্গের প্রতিনিধি। তাছাড়া দেশীয় রাজ্যের সদস্যেরা নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যসভায় আসন গ্রহণ করতে পারবেন না। তারা হবেন রাজন্যবর্গের মনোনীত।
ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধিদের মধ্যে ৬ জনকে মনোনীত করবেন বড়লাট। সংখ্যালঘু ও অনুন্নত সম্প্রদায় এবং মহিলা সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে এই ছয় জনকে মনোনীত করা হবে। বাদবাকি সদস্যদের অধিকাংশই সাম্প্রদায়িক নির্বাচনের মাধ্যমে রাজ্যসভায় স্থান পাবেন। এঁদের নির্বাচন করবেন সম্পন্ন ও প্রতিপত্তিশালী নির্বাচকেরা। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার স্বীকৃত হবে না। সব মিলিয়ে বলা হলো যে, ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হবেন সাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্র বিরোধিতার স্তম্ভ স্বরূপ।
ii) নিম্নতর কক্ষ (house of assembly কিংবা federal assembly):-
যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নিম্নতর কক্ষকে বলা হবে অ্যাসেম্বলি। নিম্নতর কক্ষে স্থান পাবেন ব্রিটিশ ভারতের ২৫০ জন প্রতিনিধি এবং দেশীয় রাজ্য সমূহ থেকে অনূর্ধ্ব ১২৫ জন প্রতিনিধি। এরা প্রত্যক্ষ বা সরাসরিভাবে নির্বাচিত হবেন না। প্রাদেশিক আইনসভা গুলি থেকে এঁদের পরোক্ষ নির্বাচন করে পাঠানো হবে। প্রাদেশিক আইন সভার হিন্দু, মুসলমান ও শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা তাঁদের নিজস্ব সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধি এইভাবে নির্বাচন করে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভায় পাঠাবেন।
যুক্তরাষ্ট্রীয় অ্যাসেমব্লির হিন্দু আসনগুলির মধ্যে কয়েকটি নির্দিষ্ট ও সংরক্ষিত থাকবে তপশীলভুক্ত (Scheduled) অনুন্নত হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, ইউরোপীয়ান ও খ্রিস্টান সমপ্রদায়ের ও বিশেষ প্রতিনিধিত্ব অনুরূপ রীতিতে স্বীকার করে নেওয়া হবে। দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিরা মনোনীত হবেন দেশীয় রাজন্যবর্গের দ্বারা, সেখানকার জনগণের দ্বারা নয়।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার কার্যকাল ও ক্ষমতা:-
যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা উভয় কক্ষের জন্য একজন করে সভাপতি থাকবেন। নিম্ন কক্ষ বা অ্যাসেমব্লির সভাপতিকে বলা হবে স্পিকার(Speaker)। অ্যাসেম্বলির কার্যকাল হবে পাঁচ বছর, তবে ইচ্ছে করলে বড়লাট তার আগেই এর অধিবেশন ভেঙে দিতে পারবেন।
উচ্চতর সভা বা রাজ্যসভা হবে স্থায়ী, তবে এর এক-তৃতীয়াংশ সদস্যকে তিন বছর অন্তর অবসর নিতে হবে। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংক্রান্ত মোটামুটি সমস্ত বিষয় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা আইন প্রণয়ন করতে পারবে। কিন্তু এই স্বাধীনতা ছিল সীমাবদ্ধ।
প্রথমত, কয়েকটা নির্দিষ্ট বিষয়ে আইন করতে হলে বড়লাটের অনুমতি লাগবে।
দ্বিতীয়ত, কতগুলা ব্যাপার নিয়ে কোন ক্ষেত্রেই আইন করা চলবেনা।
তৃতীয়ত, বড়লাটের হাতে থাকবে বিশেষ ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের ও জরুরী ব্যবস্থা অবলম্বনের ক্ষমতা।
চতুর্থত, অর্থ বরাদ্দের জন্যও বড়লাট সব সময় আইনসভার মুখাপেক্ষী থাকবেন না।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন:-
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হলেও কেন্দ্রে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রইল। কেন্দ্রে বৈদেশিক নীতি এবং প্রতিরক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলি রইল বড়লাটের হাতে। ঐসব সব ব্যাপারে কেন্দ্রীয় আইন সভার কোন কর্তৃত্ব স্বীকার করা হল না। প্রাদেশিক শাসনকর্তার হাতেও কতগুলি বিশেষ ক্ষমতা থাকলো। অর্থাৎ এই নতুন সংবিধানে ভারতের পরনির্ভরতা রয়েই গেল।
প্রাদেশিক পুনর্গঠন:-
এই আইনের দ্বারা প্রাদেশিক সরকার গুলিকে অনেকটা ঢেলে সাজানো হল। বোম্বাই প্রেসিডেন্সি থেকে আলাদা করে নিয়ে সিন্ধু প্রদেশ তৈরি হল। সংযুক্ত বিহার- উড়িষ্যা প্রদেশ থেকে উড়িষ্যা কে আলাদা করে নিয়ে তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল মধ্যপ্রদেশের ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কিছু অংশ এবং এইভাবে উড়িয়াভাষী উড়িষ্যা প্রদেশ গঠিত হল। বিশাল ব্রিটিশ ভারতের বাইরে চলে গেল এডেন ও ব্রহ্মদেশ।
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও মন্ত্রিসভা:-
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ১৯১৯ সালের আইনে যে দ্বৈত ব্যবস্থা চালু হয়েছিল সেটা তুলে নিয়ে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হল। প্রাদেশিক শাসনকর্তার হাতে আগে অনেক "সংরক্ষিত" বিষয়ের দায়িত্ব ছিল। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার হাতে ছিল কিছু "হস্তান্তরিত বিষয়"। এই ক্ষমতা ভাগাভাগি তুলে দিয়ে বলা হল যে, প্রাদেশিক শাসনকর্তা তাঁর মন্ত্রিসভার পরামর্শ ও সাহায্য নিয়ে প্রদেশ শাসন করবেন।
সাধারনত স্থানীয় আইনসভার সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রীদের নিযুক্ত করা হবে এবং স্থানীয় আইনসভার কাছে মন্ত্রিসভা দায়িত্বশীল থাকবেন। অবশ্য মন্ত্রীদের সকলেই যে জনগণের নির্বাচিত সদস্য হবেন তা নয়; মনোনীত সদস্যদেরও মন্ত্রিসভায় নিযুক্ত করা চলবে। এমন কি কেন্দ্রীয় রাজ্যসভার মনোনীত সদস্যকেও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় নিয়োগ করার স্বাধীনতা দেওয়া হল প্রাদেশিক শাসন কর্তাকে। সাম্প্রদায়িক স্বার্থ রক্ষার অজুহাতে প্রাদেশিক শাসন কর্তাকে মন্ত্রিসভা গঠনের বেলায় এই ধরনের বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হল।
প্রতিক্রিয়া:-
ভারতবর্ষের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল এই আইন কে সমর্থন জানাতে পারেননি। তাদের মতে-(i) এই ভারত শাসন আইনে গভর্নর জেনারেলকে প্রয়োজনাতিরিক্ত ক্ষমতা দান করা হয়েছে।
ii) ভারতবাসীকে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন দান করার নামে প্রতারণা করা হয়েছে।
iii) যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তোলার ব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে দেশীয় রাজ্য গুলির উপর নির্ভরশীল থাকায় ভারতীয় নেতৃবৃন্দ আশঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন এই ভেবে যে, এতে ভারতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে।
iv) আলাদাভাবে নির্বাচনের দ্বারা সংখ্যালঘু সদস্যদের নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটি প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রদায়িকতা-বাদকেই মদত দেবে।
মূল্যায়ন:-
ভারত শাসন আইন কংগ্রেসসহ ভারতবর্ষের কোন রাজনৈতিক দলকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। "সুমিত সরকার” বলেন- "এই আইনে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়ায় কোন লক্ষনই ছিল না।” পন্ডিত জহরলাল নেহেরু এই আইনকে "দাসত্বের এক নতুন অধ্যায়” বলে অভিহিত করেন। মুসলিম লীগ নেতা জিন্নাহও যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা করেন।
0 Comments