Ticker

6/recent/ticker-posts

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (১৩ই এপ্রিল ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ)



পটভূমি:- 

   প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন প্রয়োগ করে আন্দোলন দমনের প্রচেষ্টা চালায়। এই সময় পাঞ্জাবেও ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন চরমে পৌঁছায়। 

   ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ ই এপ্রিল ব্রিটিশ পাঞ্জাবের দুই জনপ্রিয় কংগ্রেস নেতা ড: সত্যপাল ও সৈফুদ্দিন কিচলুকে  গ্রেপ্তার করে। রাওলাট আইন বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করলে ঐদিন দুপুরে গান্ধীজিকেও গ্রেপ্তার করা হয়। পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারের অত্যাচারের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায়।


নিষেধাজ্ঞা অমান্য:- 

   ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ১২ ই এপ্রিল ডায়ার অমৃতসরে সামরিক আইন জারি করে। পাঞ্জাবে যাবতীয় সভা-সমিতি, মিটিং, মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তার প্রতিবাদে সেই নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করে ১৩ ই এপ্রিল বিকেল ৪.৩০ টের সময় শহরের পূর্ব দিকে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক উদ্যানে প্রায় ১০ হাজার সাধারণ মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে এক সভায় সমবেত হন।


হত্যাকাণ্ড:- 

   সভা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিনা প্ররোচনায়, কোনরকম সতর্কবাণী না দিয়ে অমৃতসরের ভারপ্রাপ্ত সামরিক অধ্যক্ষ জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে সমবেত জনতার উপর ব্রিটিশ সৈন্য গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রবেশ পথটি অবরোধ করে মাত্র ১০০ গজ ব্যবধানে ৫০ টি রাইফেল থেকে একনাগাড়ে ১০ মিনিট ধরে নিরস্ত্র মানুষ গুলির উপর ১৫০০ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয়। ফলে দু'হাজারেরও বেশি নর-নারী পশুর মত হতাহত হয়(সরকারি মতে ৩৭৯ জন নিহত ও প্রায় ১২০০ জন আহত হয়)। 

   বড় বড় অট্টালিকা ও উঁচু প্রাচীর দিয়ে চারদিক ঘেরা ঐ উদ্যান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চারটি সরু পথ ছাড়া আর কোন প্রশস্ত পথ ছিল না। তা'ছাড়া হত্যাকাণ্ডের পর পাঞ্জাবে সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি করার ফলে মৃতদেহগুলি নিহতদের আত্মীয়রা নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, আহতদের মুখে এক ফোঁটা জল দেওয়ার লোক পাওয়া যায়নি। বীভৎস দেহগুলি সেখানেই পড়ে থাকে। পাঞ্জাবের এই রক্তস্নান ভারত ইতিহাসে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নামে রক্তাক্ষরে লেখা আছে।


প্রতিক্রিয়া:-

   ১) বিশ্বকবির প্রতিক্রিয়া:- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিবাদস্বরূপ নাইট উপাধি বর্জন করেন এবং এই বর্বরতার প্রতিবাদে লেখেন- "পাঞ্জাবের দুঃখের তাপ আমার বুকের পাঁজর পুড়িয়ে দিলে”। রবীন্দ্রনাথ আরো লেখেন- "এমন একটা সময় এসেছে যখন সম্মানসূচক চিহ্নগুলি আমাদের লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে.....”।

   ২) চার্চিলের প্রতিক্রিয়া:-ভাবি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলস্টন চার্চিলও এই পাশবিক হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করে বলেন, "জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো  মর্মান্তিক ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে আর কখনো ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না”।

   ৩) রাষ্ট্রগুরু প্রতিক্রিয়া:- রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তীব্র সমালোচনা করে বলেন- "জালিয়ানওয়ালাবাগ সমগ্র ভারতে এক মহাযুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত করে”।

   ৪) গান্ধীজীর প্রতিক্রিয়া:- শান্তির পূজারী গান্ধীজীও এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে "ইয়ং ইন্ডিয়া” Young India) পত্রিকায় লেখেন-"এই শয়তান সরকারের সংশোধন অসম্ভব, একে ধ্বংস করতেই হবে”(This satanic government cannot be mended, it must be ended.)

   ৫) জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া:- জাতীয় কংগ্রেস তীব্র ভাষায় এই ঘটনার নিন্দা করে। ব্রিটিশ শাসকদের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়ে কংগ্রেস নিজেই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ঐ কমিটির সদস্য ছিলেন মোতিলাল নেহেরু, চিত্তরঞ্জন দাস, ফজলুল হক, এম. আর. জয়াকর, আব্বাস তৈয়েবজী ও মহাত্মা গান্ধী। পরে মোতিলাল কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হলে তাঁর স্থলে এম. আর. জয়াকর কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

    ১৯২০ সালের ২৫ শে মার্চ কমিটি তার রিপোর্টে জালিয়ানওয়ালাবাগের ঐ পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্রিটিশ শাসকদের দায়ী করে এবং দোষী সাব্যস্ত ক'রে "ও ডায়ার” এবং "ডায়ার” উভয়কেই শাস্তিদানের সুপারিশ করে। এইভাবে রাওলাট আইন বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতে গান্ধীজীর সত্যাগ্রহের অগ্নিপরীক্ষা হয়ে যায়।


মন্তব্য:- 

   ভারতবাসীর কাছে এই সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আপসের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে কোন অধিকার আদায় করা যাবে না। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের ফলে সরকারের ওপর থেকে নরমপন্থীদের আস্থা সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়।

Post a Comment

0 Comments