ভেষজ উদ্ভিদ:-
যেসব উদ্ভিদের ঔষধী গুন আছে অর্থাৎ ঔষধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় তাদেরকে ভেষজ উদ্ভিদ বলে। এইসব উদ্ভিদের পাতা, ফুল, ফল, বীজ গাছের ছাল এমনকি মূল থেকেও ঔষধ তৈরি হয়।
বাসক, ধুতুরা, তুলসী, পুদিনা, কালমেঘ, সিঙ্কোনা, বেলেডোনা, থানকুনি, সর্পগন্ধা, হরিতকী, আমলকি, বহেড়া এইরকম কয়েকটি ভেষজ উদ্ভিদ।
ভেষজ উদ্ভিদ গুলির মধ্যে শ্বেত বাসকের প্রচুর ঔষধি গুনের জন্য সর্ব রোগের মহৌষধ বলে গণ্য করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে বাসক দুই প্রকার যথা-
১) শ্বেত বাসক (ফুল সাদা)
২) রক্ত বাসক (গাঢ় লাল রঙের ফুল)
উদ্ভিদ পরিচিতি :-
বিজ্ঞানসম্মত নাম :- আডাটোডা বাসিকা
ইংরেজি নাম :- জাস্টিসিয়া আধাটোডা
কোথায় পাওয়া যায়:-
ভারতীয় উপমহাদেশে যেসব ভেষজ উদ্ভিদ পাওয়া যায় তাদের মধ্যে বাসক অন্যতম। আমাদের দেশে ক্ষেতে খামারে, রাস্তার পাশে, পুকুর পাড়ে, নদীর ধারে প্রায়ই এই উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায়।
প্রকৃতি:-
বাসক বহুবর্ষজীবী, দ্বিবীজপত্রী গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। শ্বেত বাসক হালকা হলুদ রঙের ডালপালা যুক্ত উদ্ভিদ। এক থেকে দুই মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। বল্লম আকারের বড় পাতাযুক্ত গাছ। সারা বছরই এদের পাতা সবুজ থাকে। জালিকা শিরাবিন্যাস যুক্ত বিষমপৃষ্ঠ পাতা। ফুল ঘন ছোট স্পাইকের উপর ফোটে। শ্বেত বাসকের ফুলের রং সাদা, তার উপর বেগুনি দাগ থাকে। কিন্তু রক্ত বাসকের ফুলের রং গাঢ় লাল রঙ্গের ফুল ফোটে। পান-সুপারি আকৃতির ডিজে ভর্তি থাকে।
চাহিদা:-
বাসক পাতায় ভাসিসিন নামক ক্ষারীয় পদার্থ এবং তেল থাকে এই পদার্থের জন্য বাসক গাছের বিভিন্ন উপাদান বিভিন্ন ঔষধিগুণ দেখায়।
শ্বেত বাসক অতি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে ।বর্তমানে এটি হোমিওপ্যাথি ও এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় ও যথেষ্ট সমাদর পাচ্ছে। বাজারে বাসক সিরাপ নামে একপ্রকার পেটেন্ট ঔষধের খুব চাহিদা।
শ্বেত বাসকের ভেষজগুণ:-
১) পুরানো কাশি ও ব্রংকাইটিসে বাসক:- বাসকের ছাল চূর্ণ 8-10 গ্রেন মাত্রায় মধুর সহিত মিশিয়ে সেবন করলে পুরানো সর্দি কাশি ও ব্রংকাইটিসে উপকার পাওয়া যায়।শ্লেষ্মা বেরিয়ে যায়।
২) হুপিং কাশির সমস্যায় বাসক পাতা:- শিশুদের বুকে ঘড়ঘড় শব্দ ,কাশতে কাশতে দম আটকে আসার উপক্রম ,কাশির প্রকোপে শরীরের রং নীলচে হয়ে আসা প্রভৃতি রোগে শ্বেত বাসকের পাতা ও ছালের রস মধুর সঙ্গে সেবন করালে অবশ্যই উপকার পাওয়া যায়।
৩) হাঁপানির টানে বাসক পাতা:- যাদের হাপের টান আছে তারা বাসক পাতা শুকনো করে বিড়ির মত বানিয়ে অথবা হুঁকোর কলকেতে সেজে তামাকের মতো ধূমপান করালে শ্বাসের টান ,হাঁপানি কষ্ট লাঘব হয়।
৪) কৃমি নাশে বাসক পাতা:- শিশুর পেটে কৃমি থাকলে বাসকের ছালের কাথ খাওয়ালে এর তিক্ত স্বাদ কৃমি বের করে দেয়।কাথ তৈরি করতে ৮- ১০ গ্রাম বাসকের ছাল থেঁতো করে ৪ কাপ পরিমাণ জলে ফোটাতে হবে। জলের পরিমাণ এক কাপ হলে নামিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। ঠান্ডা হলে সেবন করাতে হবে।
৫) বুকে জমা কফে বাসক পাতা:- যদি বুকে কফ জমে থাকে এবং তার জন্য শ্বাসকষ্ট হয় বা কাশি হয় ,বাসক পাতার ১ থেকে ২চামচ রস এক চামচ মধু সহ সেবনে কফ সহজে বেরিয়ে আসে।
৬) ঘামের গন্ধ দূর করতে বাসক পাতা:- যাদের গায়ে ঘামের গন্ধ হয় তারা বাসক পাতার রস গায়ে মেখে 30 মিনিট পর স্নান করলে ঘামের দুর্গন্ধ দূর হবে।
৭) বাতের ব্যথা ও শোথের উপশমে বাসক:- বাসকের পাতা ও ছাল ১ লিটার পরিমাণ জলে দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ফুঁটিয়ে তাকে ১/৪ লিটার পরিমাণ অবস্থায় নিয়ে এলে যে কাথ তৈরি হয় তার সেক নিলে বাতের ব্যথা এবং শোথের উপশম হয়। অথবা কয়েকটি বাসক পাতা বেটে তার সঙ্গে হলুদ ও চুন মিশিয়ে লাগালে বাতের ব্যথা কমে যায়।
৮) শ্বাসনালীর প্রদাহ জনিত ব্যধিতে বাসক পাতা:- বাসক পাতার রস বা সিরাপ শ্লেষ্মা তরল করে নির্গমে সুবিধা করে দেয় বলে সর্দি কাশি এবং শ্বাসনালীর প্রদাহ মূলক ব্যধিতে বিশেষ উপকারী।
৯) জল বিশুদ্ধি করনে বাসক পাতা:- অবিশুদ্ধ জল বাসক পাতা দিয়ে ভালোভাবে ফুঁটিয়ে নিলে জলের রোগ উৎপাদন ক্ষমতা বিনষ্ট হয় এবং তা নিশ্চিন্তে পান করা যায়।
১০) যক্ষার প্রথমাবস্থায় বাসক পাতা:- যক্ষা রোগের প্রাথমিক অবস্থায় বাসক পাতার রস কার্যকরী । যক্ষা রোগ নির্মূল হয়। তবে যক্ষা রোগীর কাশির সঙ্গে রক্ত উঠলে রক্ত বাসক বেশি উপকারী।
১১) স্বরভঙ্গ গলা ব্যথা রোগে বাসক পাতা:- বাসক পাতার রস সেবনে স্বরভঙ্গ ও গলা ব্যথা রোগ সেরে যায়।
১২) জন্ডিস রোগে বাসক পাতা:- বাসক পাতা ফুলের রস মধুসহ নিয়মিত সেবনে জন্ডিস রোগে উপকার পাওয়া যায়।
১৩) নিউমোনিয়া রোগে বাসক পাতা:- বাসক পাতার রস মধু সহ সেবনে নিউমোনিয়া ভালো হয়।
১৪) অম্লপিত্ত রোগে বাসক পাতা:- এই রোগে দীর্ঘদিন ভুগতে থাকলে অম্লশূল, ব্লাড প্রেসার, এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে এই রোগ দমন করতে বাসক ছালের কাথই যথেষ্ট। ২৫ গ্রাম বাসক গাছের ছাল থেঁতো করে ১ লিটার জলে ফোটাতে হবে। ১/৪ লিটার হলে নামিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। ঠান্ডা করে প্রতিদিন দুই থেকে তিনবার সেবনে পিত্ত রোগ নির্মল হবে।
১৫) উকুন দমনে বাসক পাতা:- বাসক পাতার রস স্নানের ৩০ মিনিট আগে মাথায় কয়েকদিন মাখলে উকুন মরে যায়।
১৬) ব্রণ শোথে বাসক পাতা:- ব্রণ শোথে (ফোঁড়ার প্রাথমিক অবস্থা) বাসক পাতা বেটে প্রলেপ লাগালে ফোলা ও ব্যথা কমে যায়।
১৭) জ্বর এবং কাশিতে বাসক পাতা:- জ্বরের সঙ্গে শুষ্ক কাশি থাকলে বাসক ছালের কাথ দিনে তিনবার সেবনে উপকার পাওয়া যায়। এই কাথ ম্যালেরিয়া জ্বরেও সমান উপযোগী।
১৮) রক্তস্রাব বন্ধে বাসক পাতা:- রক্ত পিত্ত জনিত যেকোনো জায়গা থেকে রক্তস্রাবে বাসক ছাল ও পাতার কাথ মধু সহ সেবনে রক্তস্রাব বন্ধ হয়।
১৯) দেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে বাসক পাতা:- বাসক পাতার রসের সঙ্গে শঙ্খচিল মিশিয়ে নিয়মিত গায়ে মাখলে গায়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।
২০) বসন্ত রোগের সংক্রমণে বাসক পাতা:- পাড়া জুড়ে বসন্ত রোগের হাত থেকে বাঁচতে বাসক পাতা সিদ্ধ জল প্রত্যহ সেবন করলে বসন্ত রোগ সংক্রমণের ভয় থাকেনা।
২১) ঋতুস্রাব সমস্যা বাসক পাতা:- ঋতুস্রাব সমস্যায় বাসক পাতার রস সেবন করলে সমস্যা দূর হয়।অনেকেরই ঋতুস্রাবের সময়ে পেটে ব্যথা, অতিরিক্ত রক্তপাত ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। তাঁরা নিয়মিত বাসক পাতার রস সেবন করলে এই রোগ থেকে মুক্তি পাবেন।
২২) প্রস্রাবের জ্বালা যন্ত্রণা দূর করতে বাসক পাতা:- প্রস্রাবে জ্বালা-যন্ত্রণা থাকলে বাসকের ফুল বেটে মিছরি সহ শরবত করে সেবনে প্রস্রাবের জ্বালা যন্ত্রণা কমে যায়।
২৩) দাদ ও চুলকানিতে বাসক পাতা:- বাসকের কচি পাতা কাঁচা হলুদের সঙ্গে বেটে দাগ এবং চুলকানিতে লাগালে তা সেরে যায়।
২৪) পাইরিয়া বা দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া রোধে বাসক পাতা:- পাইরিয়া বা দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়লে বাসক পাতা জলে সিদ্ধ করে ঈষদুষ্ণ অবস্থায় কুলকুচি করলে এ রোগ সেরে যায়।
২৫) অর্শের বলির যন্ত্রণায় বাসক পাতা:- থেতো বাসক পাতা অল্প গরম করে পুঁটুলি বেঁধে মলদ্বারে সেক দিলে বলির যন্ত্রণা ও ফোলা দুয়েরই উপশম হয়।
২৬) মাংসপেশিতে টান ধরলে বাসক পাতা:- চুন হলুদের সঙ্গে বাসক পাতা বেঁটে মালিশ করলে উপকার পাওয়া যায়।
২৭) শরীরের রং উজ্জ্বল করতে বাসক পাতা:- বাসকের পাতা সবুজ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং তা থেকে শরীরে হলদে রং পাওয়া যায়।
২৮) খিচুনি রোগের বাসক পাতা:- বাসক পাতার রস নিয়মিত সেবনে খিঁচুনি রোগ দূর হয়।
অন্যান্য কাজে বাসক পাতা:-
১) টিউমার হয়েছে কিনা বুঝতে :- চরক ও সুশ্রুত এর যুগে বাসক পাতার রস খাইয়ে শরীরে কোথাও টিউমার হয়েছে কিনা তা নির্ণয় করা হত।
২) ফল প্যাকিং এবং সংরক্ষণের কাজে বাসক পাতা:- বাসক পাতায় এমন কিছু ক্ষারীয় পদার্থ আছে যার ফলে ছত্রাক জন্মায় না এবং পোকামাকড় ধরে না বলে ফল প্যাকিং এবং সংরক্ষণের কাজে বাসক পাতা ব্যবহৃত হয়।
৩) জমির ফসল উদ্ধারে বাসক পাতা:- চাষের জমির চারপাশ দিয়ে বাসক গাছ লাগালে ফসল সুরক্ষিত থাকে। বাসক পাতার দুর্গন্ধের জন্য পশুরা বাসক পাতায় মুখ দেয় না ফলে জমির ফসল রক্ষা পায়।
বাসকের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া:-
১) প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খেলে বমিভাব, বমি এমনকি পেটের নানারূপ সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
২) গর্ভবতী মহিলাদের বাসক পাতা খাওয়া উচিত নয়। এতে মা ও শিশুর শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
৩) নিয়মিত বাসক পাতা খেলে রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে যেতে পারে। ফলে শরীরে অস্বস্তি দেখা দিতে পারে।
সতর্কতা:-
বাসক পাতা ব্যবহারের পূর্বে ভালো ভাবে জলে ধুয়ে পরিষ্কার করে তবে তা ব্যবহার করা উচিত। কারণ পরিবেশের নোংরা, ধুলোবালি পাতার উপর থাকে ফলে রোগ জীবাণু ছড়াতে পারে। বিশেষ করে বাচ্চাদের বেলায় খুবই সর্তকতা অবলম্বন করা উচিত।
2 Comments
ওয়ান্ডারফুল পাতা
ReplyDeleteতেঁতুল পাতার উপকারিতা
ReplyDeleteসম্পর্কে কিছু তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করো।