১৮৭৯ সালের ৭ই ডিসেম্বর নদীয়া জেলার কুষ্টিয়ায় (বর্তমানে বাংলাদেশ) মামার বাড়িতে বাঘাযতীন বা যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পিতার নাম উমেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মাতার নাম শরৎশশী দেবী। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর মাত্র ৩৬ বছর বয়সে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেন।
কর্মজীবন :-
তিনি ছিলেন বেঙ্গল গভর্নরের ব্যক্তিগত সচিবের সরকারি চাকরিরত। কিন্তু দেশমাতার গভীর ভালোবাসার টানে সরকারি চাকরি ছেড়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১৯০২ সালে তিনি কলকাতা বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে মিলিত হন। বিপ্লবী দলের সঙ্গে মিশে শিখেছেন বিপ্লবী কর্মকান্ড। তারপর কলকাতায় ১০২ নং আপার সার্কুলার রোডে গড়ে তোলেন বিপ্লবী আখড়া।
ঘটনাপ্রবাহ:-
১৯০৮ সালে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী মুজাফফরপুর বোমা ছুঁড়ে মিসেস কেনেডি ও তাঁর কন্যাকে হত্যা করার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ নানা স্থানে তল্লাশি শুরু করে।
যতীনের বোমা তৈরির কারখানা থেকে পুলিশ উদ্ধার করে প্রচুর তাজা বোমা ও অস্ত্র শস্ত্র। এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত সন্দেহে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ ও তার ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষ সহ মোট ৪৭ জন বিপ্লবী কে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। শুরু হয় আলিপুর বোমার মামলা।কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে যতীনকে ছেড়ে দেয় পুলিশ
জার্মানের প্রতিশ্রুতি:-
১৯১৪ সালের আগস্টে জার্মানদের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধে ব্রিটিশদের। ফলে ব্রিটেন জার্মানির শত্রু দেশে পরিণত হয়।
সশস্ত্র বিপ্লব পরিচালনার জন্য বিপ্লবীরা ব্রিটেনের শত্রু জার্মানির কাছ থেকে অস্ত্র সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পান। বলা হয়, জার্মানি থেকে মাভেরিক, অ্যানি লারসেন ও হেনরি এস নামে তিনটি জাহাজে অস্ত্র পাঠানো হয়েছে। এই অস্ত্র এলে সুন্দরবনের রায়মঙ্গল, উড়িষ্যার বালেশ্বর ও হাতিয়ায়না নামাবার ব্যবস্থা করা হয়।
এই অস্ত্র এলে তা পূর্ব বাংলা কলকাতা ও বালেশ্বরের পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। যতীন্দ্রনাথ ও তার চার সঙ্গী চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষ পাল, নীরেন দাশগুপ্ত ও মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত বুড়িবালামের তীরে উপস্থিত হন। উদ্দেশ্য, জার্মান অস্ত্র ব্যবহার করে বালেশ্বর রেললাইন দখল করে ব্রিটিশ সৈন্যদের মাদ্রাজ থেকে কলকাতা ভ্রমণ বন্ধ করা।
অভিযান:-
অস্ত্র সংগ্রহ যাতে সুচারুভাবে সম্পূর্ণ হয়, সেজন্য বাঘাযতীনেরা কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে যান। এই দল ১৯১৪ সালের ২৬ শে আগস্ট কলকাতার অস্ত্র ব্যবসায়ী" রডা অ্যান্ড কোম্পানীর" আমদানি করা ৫০টি মাউজার পিস্তল ও ৪৬০০০ রাউন্ড গুলি বিপ্লবীরা কৌশলে লুঠ করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেন।
বিপ্লবীদের একটি দল জার্মানির পাঠানো অস্ত্র সংগ্রহ করতে যদু গোপাল মুখোপাধ্যায় এর নেতৃত্বে সুন্দরবনের রায়মঙ্গলে রায়। একটি গোষ্ঠী কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দখলের পরিকল্পনা নেয়।
বাঘাযতীন ও তার চার সঙ্গী চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষ পাল, নীরেন দাশগুপ্ত ,ও মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত কে সঙ্গে নিয়ে "মাভেরিক ” থেকে অস্ত্রশস্ত্র আনার জন্য বালেশ্বরে উপস্থিত হন।
বুড়িবালামের যুদ্ধ :-
কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশ গোপনে ওই জাহাজ গুলির ভারতে আসার সংবাদ পেয়ে গেলে ওগুলি আর নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে পারেনি। উপরন্ত কলকাতার পুলিশ কমিশনার "চার্লস অগাস্টাস টেগার্ট" বাঘাযতীন কে ধরার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র পুলিশের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে বালেশ্বর পৌঁছান।
বাঘাযতীন প্রথমে পুলিশের নজর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে বুড়িবালাম নদীর তীরে ঘাঁটি তৈরি করে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হন।
৯ই সেপ্টেম্বর ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে উভয় পক্ষে ২০ মিনিট ধরে রীতিমত খন্ডযুদ্ধের পর দেখা গেল চিত্তপ্রিয় নিহত এবং যতীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিষ মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন।
পরদিন (১০ই সেপ্টেম্বর,১৯১৫) ভোরে বালেশ্বর হাসপাতালে বীর বিপ্লবী বাঘাযতীন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জ্যোতিষ সুস্থ হয়ে উঠলে বিচারে ১৪ বছরের কারাদণ্ড হয়। নীরেন ও মনোরঞ্জনের ফাঁসি হয়।
পরে কারারুদ্ধ অবস্থাতেই জ্যোতিষ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। "বালেশ্বর সংগ্রাম" বা "বুড়িবালামের যুদ্ধ ” নামে খ্যাত যতীন্দ্রনাথ ও তাঁর সহ বিপ্লবীদের ওই সংগ্রাম ভারতের বিপ্লবের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা।
পরবর্তী প্রজন্মের আদর্শ:-
বিদেশি সাহায্য নিয়ে ভারত কে স্বাধীন করার সংকল্পে বুড়িবালামের যুদ্ধে বাঘাযতীনের আত্ম বলিদান অবশ্যই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছিল। যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যুগান্তর দলের সদস্যরা সংঘটিত হয়। বাঘাযতীনের বিপ্লবী জীবনের কর্মকাণ্ড তাঁকে ইতিহাসে স্মরণীয় করে রেখেছে।
1 Comments
Bhalo
ReplyDelete